বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্র বাড়লেও বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম সমন্বিত অঞ্চল হলো দক্ষিণ এশিয়া। মূলত সমন্বয়হীনতার কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যয় প্রত্যাশিতহারে কমানো সম্ভব হচ্ছে না। যদিও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এখানকার দেশগুলোর উল্লেখযোগ্য ব্যয় কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার দিকে এগিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) প্রকাশিত ত্রৈমাসিক বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আইসিসিবির এই বুলেটিনে দাবি করা হয়, বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে কম সমন্বিত অঞ্চলের একটি। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ অঞ্চলের সব দেশে মুনাফা উল্লেখযোগ্য বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। যেখানে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যে এখন সেই সম্ভাবনার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ পর্যন্ত পৌঁছানো গেছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সমন্বয় বাড়িয়ে শুধু বিবিআইএনভুক্ত বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের বিদ্যুতের বাজার আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন ডলারের মূলধন ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব। একইভাবে পরিবহন ও লজিস্টিকসের উন্নতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় কনটেইনার চলাচলের জন্য খরচ ৫০ শতাংশের বেশি কমতে পারে। ত্রৈমাসিক বুলেটিনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও যোগাযোগ সহযোগিতায় বর্তমানে কার্যকর থাকা বিভিন্ন চুক্তি তুলে ধরা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, সার্ক দেশগুলো ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে সার্ক প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেডিং অ্যাগ্রিমেন্ট (সাপটা) স্বাক্ষর করেছিল, যা সার্ক অঞ্চলের মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রচারের লক্ষ্যে ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালে কার্যকর হয়েছিল। তবে সাপটা ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (সাফটা) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। আবার এই সাফটা ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ায় তিনটি দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) রয়েছে, এগুলো হলো ভারত-শ্রীলঙ্কা, ভারত-ভুটান ও পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০১৫ সালের জুন মাসে, এটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আরেকটি উদ্যোগ। আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং পরিবহনে বিবিআইএন দেশগুলোর মধ্যে গভীর সম্পর্ক ক্রমবর্ধsমান সংযোগ চুক্তির দ্বারা প্রতিফলিত হয়। যেগুলোর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব, যার সুযোগ অনেকাংশে এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আরও উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য-বাণিজ্য সহযোগিতার প্রকৃত সম্ভাবনার চেয়ে অনেক নিচে রয়ে গেছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য আনুমানিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা সম্ভাব্য ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য প্রবাহের মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও অন্যান্য অঞ্চলে বাণিজ্যের অনুপাত পূর্ব এশিয়ায় ৫০ শতাংশ, আসিয়ানে ২৬ শতাংশ, ইইউতে ৬৭ শতাংশ, নাফটায় ৬২ শতাংশ, লাকে এবং কমেসায় ২২ শতাংশ। এদিকে ২ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী ছাড়িয়ে যাওয়া অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়া। যার একটি শক্তিশালী ৪ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি রয়েছে। যেখানে ভারত ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী এবং ৩ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিসহ ২১ শতকের বিকাশমান অর্থনীতির মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। তবে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও লজিস্টিক নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি ট্রানজিট দেশ হিসেবে কাজ করার জন্য ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২২ অর্থবছর ছিল মাত্র ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি ছিল মাত্র ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিভিন্ন বাণিজ্য বাধা কমিয়ে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে, যদি এটি মোট ভারতীয় আমদানির মাত্র ১ শতাংশও হয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বর্তমান মাত্রা থেকে ১৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে, যদি বাংলাদেশ ও ভারত একটি মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়ন করে। দুই দেশের মধ্যে পরিবহন সংযোগ উন্নত করলে রপ্তানি আরও বাড়তে পারে, ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ২৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পাবে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশ এবং অন্য দেশগুলো তাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় দূরবর্তী অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্য বেশি করে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাংকের কানেক্টিং টু থ্রাইভ রিপোর্টে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের একটি কোম্পানির জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় জার্মানির একটি কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য করা কম ব্যয়বহুল। এ ছাড়া একটি সুপ্রতিষ্ঠিত পরিবহন নেটওয়ার্ক বাণিজ্য সংযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও একীকরণকে উন্নীত করতে পারে। আরও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য, সার্ক নেতারা পর্যায়ক্রমে এবং পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার রূপকল্পে সম্মত হয়েছে, যা অবশেষে একটি দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নের (সাইইউ) দিকে এগোচ্ছে; কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, এই অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো, ভালো সংযোগ স্থাপন এবং সব বাণিজ্য বাধা দূর করতে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। ভারতের জি-২০ প্রেসিডেন্সি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাসহ জলবায়ু ও এনার্জির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং অনুকূল জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সুযোগ নিয়ে আসতে পারে।
মন্তব্য করুন