সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেআইনিভাবে সংবাদ সম্প্রচারের অভিযোগে চট্টগ্রামের ইউটিউব চ্যানেল ‘সিপ্লাস টিভি’সহ বেশকিছু চ্যানেলের অফিসে অভিযান চালিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানের পর এসব তথাকথিত চ্যানেলের অফিস সিলগালা করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে মালপত্র।
গতকাল রোববার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এহসান মুরাদ ও হিমাদ্রি খীসার নেতৃত্বে এসব অভিযান পরিচালিত হয়। সিলগালা করা চ্যানেলগুলো হলো ‘সি ভিশন’, ‘এসবি টিভি’, ‘দৈনিক অর্থনীতি’ ও ২৪ টিভি।
ম্যাজিস্ট্রেট এহসান মুরাদ কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান তিনটির ক্যামেরা, লাইটসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র জব্দ করা হয়। অভিযান চলাকালে অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য তারা বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।’ জেলা প্রশাসন জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে অবৈধ আইপি টিভি, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, পোর্টাল ব্লগসহ অনলাইন টিভির রমরমা ব্যবসা। জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালায় বর্ণিত নির্দেশনা লঙ্ঘন ও জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা অমান্য করে গড়ে ওঠে এসব ভুঁইফোঁড় অনলাইন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের টিভি-২ শাখার নির্দেশনা মোতাবেক এ অভিযান চালানো হয়।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এসব চ্যানেলের অফিসে অভিযান চলে। ২৪ টিভি চ্যানেলের কার্যালয়ে পাওয়া যায় ভেজাল মসলা, ভোজ্যতেল, হেয়ার ওয়েল ও মধু। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) পক্ষ থেকে ওই টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে।
‘অপুর সিপ্লাস চ্যানেল আস্ত টাকার গাছ!’ শিরোনামে গত ৪ জুন সংবাদ প্রকাশ হয় দৈনিক কালবেলাসহ একাধিক পত্রিকায়। ওইসব প্রতিবেদনে বলা হয়, আলমগীর অপুর তথাকথিত ‘সিপ্লাস টিভি’তে সংবাদ প্রচারের নামে আর্থিক অনিয়ম করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক কলহ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কলহও ঘটা করে ওই চ্যানেলে আপলোড করা হয়।
পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিটি কনটেন্টের জন্য সুবিধাভোগী বা স্বার্থন্বেষী মহল থেকে নেওয়া হয় টাকা। আবার চাহিদামতো টাকা না পেলে উল্টো নেতিবাচক তথ্যও আপলোড করা হয়। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যায়ে তথাকথিত সাংবাদিক নিয়োগ দিয়েছেন অপু। তাদের মাধ্যমে চলত টাকার লেনদেন। অভিযোগ ওঠে, এ চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশের নামে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন অপু। এমনকি নগরের ওয়াসার মোড়ে যেখানে তিনি বসেন, সেটিও দখল করেছেন। তার হলুদ সাংবাদিকতায় বিব্রত ও ক্ষুব্ধ মূলধারার সাংবাদিকরা।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে গ্রামপর্যায়ে তথাকথিত সাংবাদিক নিয়োগ দেন অপু। তাদের মাধ্যমেই চলে টাকার লেনদেন। সেই টাকায় গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ কোটি টাকার সম্পদের মালিক এ ইউটিউবার। তার দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ নগর থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি অনলাইনভিত্তিক নিউজ পোর্টালগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে বেশ কয়েকটি পোর্টাল নিবন্ধন চায়। এর মধ্যে সিপ্লাস টিভিও ছিল। কিন্তু জমি দখল, মাদক বাণিজ্য, ক্যাসিনোকাণ্ডে সম্পৃক্ততাসহ নানা কারণে সেটি নিবন্ধন পায়নি বলে জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেন, আলমগীর অপুর বিরুদ্ধে কর্মীদের বেতন না দেওয়া, অফিসে জুয়ার আসর বসানো, ফ্ল্যাট দখল করে অফিস বানানোসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে শুরু থেকেই ফেসবুকে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে আলোচনায় থাকার চেষ্টা চালাতেন এ অপু। সম্প্রতি ফেসবুকে সরকারবিরোধী স্ট্যাটাস দিয়ে আবারও সমালোচনার মুখে পড়েন। একপর্যায়ে নিজের ওয়াল থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেন। তবে সেই পোস্টের স্ক্রিনশট থেকে যায় অনেকের টাইমলাইনে। ওই পোস্টে অপু লেখেন, গাজীপুরে বয়স্ক জায়েদা খাতুনের এত ভোট পাওয়া কি জনপ্রিয়তা নাকি কুশাসনের ফসল? স্ট্যাটাসটি নিয়ে সমালোচনা শুরুর পর আলমগীর অপুকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান অনেকে। তাদের দাবি, এ ধরনের মন্তব্য দেশদ্রোহের শামিল।
গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র বলছে, অপুর সরকারবিরোধী পোস্টগুলোর উদ্দেশ্য উদ্ঘাটনে চলছে বিশেষ নজরদারি। সরকারবিরোধীদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে এসব পোস্ট শেয়ার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কালবেলার হাতে আসা সিপ্লাসের একটি কনফিডেনশিয়াল চিঠিতে দেখা গেছে, যে কোনো ধরনের খেলাধুলার নিউজ, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের সংবাদ প্রচারে দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। সব ধরনের ধর্মীয় সংবাদ, রাজনৈতিক পরিচিতি আছে কিংবা সরকারি পদ আছে, এমন কারও ব্যক্তিগত কর্মসূচির নিউজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পুনর্মিলনী-বর্ষপূর্তির সংবাদের ক্ষেত্রে দিতে হয় ১ হাজার টাকা করে।
তা ছাড়া রাজনৈতিক পরিচিতি নেই, এমন কারো ব্যক্তিগত কর্মসূচি, মেলার সংবাদের ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংবাদ প্রচারে ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া সংবাদের নামে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হয়রানির অভিযোগও রয়েছে এ চ্যানেলের বিরুদ্ধে।
নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিলেও অপুর ভাই মুজিবুল হক মঞ্জু দুবাই বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব পদে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া অপুর বোন জিন্নাত রাজ্জাক চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির নেত্রী।
সম্প্রতি তিনি বিএনপির এক মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে সরকারবিরোধী নানা বক্তব্য দেন। অপুর সাম্প্রতিক লন্ডন সফর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের এক নেতা ফেসবুকে লেখেন, আলমগীর অপু, দালালির জন্য তারেক রহমান আপনাকে কত টাকা দিয়েছেন?
মন্তব্য করুন