সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী সেশনজটের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। তাই দ্রুত কোটা পদ্ধতি বিষয়ে আলোচনা করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলেছেন শিক্ষাবিদ ও আমলারা। আলোচনার টেবিলেই যৌক্তিক সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।
২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। তবে ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন হলে মন্ত্রিসভা ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই সরকার জানায়, সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা বহাল নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে (১৪তম থেকে ২০তম পর্যন্ত) কোটা বহাল রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ প্রার্থীর মেধাতালিকা থেকে তা পূরণ করতে হবে। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কোটার বিষয়ে আগের জারি করা পরিপত্র স্পষ্ট করার পাশাপাশি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সরকারি চাকরিতে অষ্টম বা তার ওপরের পদেও সরাসরি নিয়োগের কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়।
এরপর মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে অহিদুল ইসলাম তুষার উচ্চ আদালতে ২০২১ সালে রিট মামলা করেন। এ মামলার শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্য কোটা বাতিল করে জারি করা ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। ওই দিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন। এতে যোগ দেন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এ অবস্থায় আদালতের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। এরপর হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন চেম্বার আদালত। একই সঙ্গে এ বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৪ জুলাই দিন নির্ধারণ করা হয়।
সেদিন হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি মুলতবি করেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও থামেনি। লাগাতার কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামীকাল রোববার থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করবেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষাবিদ ও আমলারা বলছেন, ২০১৮ সালের কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল চায়নি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা; কিন্তু তখন পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দেওয়ায় নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে। এর সমাধান সরকারকেই করতে হবে, আলোচনার মাধ্যমে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান কালবেলাকে বলেন, ২০১৮ সালের আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল চায়নি। তারা যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল; কিন্তু তখন পুরো কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছিল। সে সময়েই আলোচনার মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হলে এখন নতুন করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করা লাগত না।
তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটা চালু রয়েছে। তবে সেটি ১০ শতাংশের বেশি নয়। বাংলাদেশেও আদিবাসী ও নারী কোটা রাখা যেতে পারে। আলাপ-আলোচনার পর এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করা দরকার। নীতিমালায় কয়বার কোটা সুবিধা পাওয়া যাবে, সেই বিষয়টিও থাকা দরকার। কারণ, একবার কোটা সুবিধা পেলে তিনি আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নন।
আবু আলম মো. শহীদ খান আরও বলেন, দেশের কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, মজুররা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাদের জন্যই কোটা ব্যবস্থা এসেছিল; কিন্তু এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়েও বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সেখানে ২০১৮ সালের পরিপত্র নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংসদেও আলোচনা হতে পারে। যদি সরকার চায় সেটিও সমাধানের সূত্র হতে পারে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত কতজন কোটা সুবিধার আওতায় এসেছে, সে বিষয়েও গবেষণা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, দেশ পরিচালনা করতে গেলে সংকট আসবেই। এর সমাধান করতে হবে আলোচনায় বসে। দুনিয়ায় এমন কোনো সংকট নেই, যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায় না। সে কারণে কোটা পদ্ধতি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসলে সমাধান আসবেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, একটা সময় পর্যন্ত কোটা পদ্ধতির যৌক্তিকতা ছিল। তবে নারীরা এখন অনেক এগিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিরা অনেক বছর চাকরিতে কোটা সুবিধা পেয়েছে। তবে অনগ্রসর জাতিকে সমতায় আনা যেহেতু রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব, সেক্ষেত্রে কোটার দরকার আছে। সেজন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, নারী এবং শ্রদ্ধাবোধ রেখে কয়েক শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা যায়; কিন্তু সেটি ৫৬ শতাংশ নয়। এতে মেধাবী অনেকে চাকরিবঞ্চিত হবে। সব জায়গায় মেধাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমার মনে হয়, পুরো কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়া যাবে না। সব মিলিয়ে ৫-১০ শতাংশ কোটা রাখা যায়।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যৌক্তিক দাবি করে তিনি বলেন, এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা রয়েছে। তবে আদালত যেহেতু এ বিষয়ে রায় দিয়েছেন, সমাধানও আদালতের মাধ্যমেই আসতে হবে।