অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার তিন সপ্তাহ পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শনিবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শুরু হওয়া মতবিনিময় সভা শেষ হয় রাত ৮টার দিকে। সভায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। মতবিনিময় সভা শেষে বিভিন্ন দলের নেতারা গণমাধ্যমের কাছে এ কথা জানান। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা মতবিনিময়কালে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারসহ নির্বাচনের বিষয়ে মতামত প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। মতবিনিময়কালে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা এএফএম খালিদ হোসেন, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলের নেতারা জানান, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামবিরোধী কোনো আইন বা পদক্ষেপ না নেওয়ার দাবিও জানান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তিসমূহ বাতিল, একই ব্যক্তি যাতে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন, সেই প্রস্তাবনা দেন রাজনীতিকরা। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আলাদাভাবে বিভিন্ন প্রস্তাবনা লিখিতভাবে উপস্থাপন করেন। নেতাদের এসব বক্তব্য ও প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্ব সহকারে শোনেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান।
এই ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া চালু রাখবে সরকার। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে সংস্কার প্রস্তাব যা আসবে সেগুলো গ্রহণ করব।
মতবিনিময়কালে ইসলামী দলগুলো দুর্গাপূজা উপলক্ষে মন্দির, পূজা মণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃবৃন্দের কাছে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন, যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। ইসলামী দলগুলোর নেতারা বৈঠকের পর বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছেও তুলে ধরেন।
গতকালের মতবিনিময়ে কতটি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তা নির্দিষ্টভাবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানা যায়নি। তবে আমন্ত্রিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে মতবিনিময়ের আমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং যত কম সংখ্যক সদস্য নিয়ে মতবিনিময়ে যান।
বিকেল ৩টায় প্রথমে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং নেজামে ইসলাম বাংলাদেশের সঙ্গে মতবিনিময় হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ জাসদ, ১২ দলীয় জোট, গণফোরাম ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় হয়।
খেলাফত মজলিসের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ। প্রতিনিধিদলে ছিলেন মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, কেন্দ্রীয় নেতা সাখাওয়াত হোসেন, ব জাহাঙ্গীর হোসেন, মুনতাসীর আলী ও কাজী মিনহাজুল ইসলাম মিলন। মাওলানা ইউসুফ আশরাফের নেতৃত্বে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রতিনিধিদলে ছিলেন মাওলানা মামুনুল হক ও মাওলানা জালাল উদ্দিন। মাওলানা সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে ছিলেন মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও মুনীর হোসেন কাশেমী। নেজামে ইসলামের প্রতিনিধিদলে ছিলেন নির্বাহী সভাপতি মাওলানা আশরাফুল হক, মহাসচিব মাওলানা মোমিনুল ইসলাম। খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন নায়েবে আমির মাওলানা মজিবুর রহমান হামেদি। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি।
গণফোরামের প্রতিনিধিদলে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, মোস্তফা মহসীন মন্টু, সুব্রত চৌধুরী, এসএম আলতাফ হোসেন, মিজানুর রহমান, জগলুল হায়দার আফ্রিক, মহিব উদ্দিন আবদুল কাদের ও মোশতাক আহমেদ। এলডিপির প্রতিনিধিদলে ছিলেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, ড. রেদোয়ান আহমেদ, নেয়ামুল বশির, নুরুল আলম তালুকদার ও আওরঙ্গজেব বেলাল। জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি ছিলেন জি এম কাদের, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান চুন্নু, মাশরুর মওলা ও মনিরুল ইসলাম মিলন।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রতিনিধিদলে ছিলেন এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, গণদলের এটিএম গোলাম মওলা চৌধুরী, এনডিপির আবু তাহের, বাংলাদেশ ন্যাপের শাওন সাদেকি, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ডিএলএর খোকন চন্দ্র দাস।
১২ দলীয় জোটের প্রতিনিধিদলে ছিলেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, বাংলাদেশ এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহিউদ্দিন ইকরাম, লেবার পার্টির একাংশের লায়ন ফারুক রহমান, জাগপার একাংশের তাসমিয়া প্রধান, কল্যাণ পার্টির শামসুদ্দিন পারভেজ ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের শাহ আহমেদ বাদল। বাংলাদেশ জাসদের প্রতিনিধিদলে ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া, নাজমুল হক প্রধান, মুশতাক হোসেন, আবদুল কাদের হাওলাদার, কাজী সদরুল হক।
মতবিনিময় শেষে এলডিপির অলি আহমদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যস্ত রাখার জন্য একমাত্র অস্ত্র হলো একটা আগাম ঘোষণা (ফোরকাস্ট) দিয়ে দেওয়া। এটা ছয় মাস বা নয় মাস পরও হতে পারে। সংস্কার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার কথা আমরা বলেছি। কিন্তু নির্বাচন তো হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্যও ভালো, রাজনৈতিক দলের জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। তবে সংস্কার করার আগে নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই বাঞ্ছনীয় নয়। সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। সবাইকে ঐকমত্য হতে হবে। ৮৩ দফা প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টাকে দিয়েছেন বলেও জানান এলডিপি প্রধান।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা একটি যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বলেছি। প্রধান উপদেষ্টাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর তারা কালবিলম্ব না করে নির্বাচনে যেতেই আগ্রহী এবং সেই ধরনের প্রস্তুতি ও আয়োজন তারা করছেন।
মামুনুল হক বলেন, সংবিধানে আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের যে ধারাটি ছিল, সেটা পুনর্বহালের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছি। দেশে নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী নীতি বা আইন যেন না হয়, সে বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়েছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার প্রায় ১৬ বছর পর্যন্ত তাদের মনগড়া দলীয়করণ যে তিনটি নির্বাচন করেছে, এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে একটা কমিশন গঠনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি প্রধান উপদেষ্টাকে। যোগ্যদের দিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছি। এসব জায়গায় একটা স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি হওয়ার আগে নির্বাচন হলে আবারও আগের সেই পরিবেশের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন, স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যার বিচারসহ ১৩ দফা দাবি প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া হয়েছে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা যেসব চুক্তি করেছেন, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে দেশবিরোধী চুক্তিগুলো বাতিল করার কথা আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি। একই সঙ্গে আলেম সমাজ ও বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের দেওয়া মামলাগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের একটা টাইমফ্রেমের কথা বলেছি। পাশাপাশি আশু সংস্কারের সাত দফা প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, ২০১৩ সাল থেকে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তিন শতাধিক মামলা আমরা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। সেই মামলাগুলো নির্বাহী আদেশ এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের ব্যবস্থার কথা বলেছি।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে অন্যান্য দল ও সেনাবাহিনী আলোচনা করে এই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে এই সরকারকে স্বাগত জানানো হলেও গত ২৪ আগস্ট থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রশ্নে ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি জানাচ্ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। পরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে উপদেষ্টা মতবিনিময় করবেন।’
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গত ১২ আগস্ট মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি, ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, শাহ আলমের নেতৃত্বে সিপিবি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে গণতন্ত্র মঞ্চ, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বে বিজেপি, মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীমের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এএফএম সোলায়মান চৌধুরীর নেতৃত্বে এবি পার্টি, নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে গণঅধিকার পরিষদ, হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বে এনডিএম আলাদা আলাদাভাবে মতবিনিময় করে।