প্রবাহিত বাতাস কিংবা একটা উড়ন্ত ঘুড়ি—হঠাৎ থেমে গেলে কী হয়? কোথায় যেন হারিয়ে যায়। টেস্ট ক্রিকেট থেকে সাকিব আল হাসানের অবসরের ঘোষণাও অনেকটা সেরকমই হলো। যেন উড়তে থাকা কোনো ঘুড়ি হঠাৎ থেমে গেল! সতীর্থরাও জানলেন না, কেউ বুঝলেন না। অথচ এক মাস ধরে সিদ্ধান্তটা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ভারতের কানপুরের ‘২১ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে’ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারের শেষটা জানিয়ে গেলেন অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার।
১৫ মিনিট পর সাকিব আসবেন—বিসিবি মিডিয়ার পক্ষ থেকে এমন বার্তার পর কানপুরের প্রেসবক্সে দুরকম আলোচনা শুরু হয়েছিল। একদল বলে উঠল, টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছেন সাকিব। আরেক দল বলল, নিলেও সেটা ভারতের মাটিতে কেন? সাকিব তো দেশের মাটিতে বিদায় নেবেন—এমনটাই বলে এসেছিলেন। দুপক্ষের কথাই সাকিবের উত্তর শেষে সত্যি হলো। সাকিব বিদায় নিচ্ছেন, তবে সেটা দেশের মাটিতেই। সেই চেনা মিরপুরে। যেখানে শত শত ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা আছে বাঁহাতি অলরাউন্ডারের। সাকিব ঘোষণাটা দিলেন এভাবে, ‘আমি যেটা অনুভব করেছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোম সিরিজ আমার শেষ সিরিজ হবে; বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে। ওটা নিয়েই আমার চিন্তা ছিল। এ নিয়েই নির্বাচকদের সঙ্গে, ফারুক ভাইয়ের (বিসিবি সভাপতি) সঙ্গে কথা হয়েছে।’ অর্থাৎ সাকিবের সিদ্ধান্তটা হুট করেই নয়!
সম্ভব হলে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টটা মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে খেলতে চান সাকিব। আগামী মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকা দল আসছে বাংলাদেশ সফরে। গতকাল কানপুরে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর ঘোষণা করে সাকিব বলেছেন, যদি তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়, তিনি শেষ টেস্টটা দেশের মাটিতে খেলতে চান।
তবে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ ওইদিন বোর্ড সভা শেষে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। তাকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নির্দিষ্ট একজনকে ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বিসিবির।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসতে হবে। বিসিবি কোনো এজেন্সি না, পুলিশ না, র্যাব না। সরকারের তরফ থেকে নিরাপত্তার ব্যাপারটি আসতে হবে।’ তবে অবশ্য বিসিবি সভাপতি খুব করেই চান সাকিব তার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট দেশের মাটিতে খেলুক।
বিসিবির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাওয়ালপিন্ডিতে প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর সঙ্গে প্রথমবার টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে আলাপ করেছিলেন সাকিব। তখন মাত্রই বিসিবির সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন ফারুক আহমেদ। সাকিব তার ভাবনা নতুন সভাপতিকেও জানিয়েছিলেন। তবে দুপক্ষ থেকেই আরও ভাবতে সময় দেওয়া হয়েছিল ৩৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারকে। চেন্নাই টেস্ট চলাকালে সাকিব নিজের সিদ্ধান্ত জানান তার ক্রিকেট গুরু, শৈশবের কোচ ও বিসিবি পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিমকেও। এবার কানপুর টেস্ট শুরুর দুদিন আগেই নির্বাচক হান্নান সরকার, অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তকেও নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। এরপর টিম থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরের ঘোষণার ব্যবস্থা রাখা হয় কানপুরের সংবাদ সম্মেলনে।
সাকিব কি কোনো চাপে পড়েই এমন সিদ্ধান্ত নিলেন! সম্প্রতি হত্যা মামলা থেকে শুরু করে নানা দিক থেকে চাপে আছেন তিনি। দেশে ফেরা নিয়েও আতঙ্কে আছেন তিনি। তবে সাকিব বললেন—এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো কষ্ট বা অভিমান ছিল না, ‘না কষ্ট বা অভিমান থেকে নয়। আমার মনে হয় এটাই সঠিক সময় মুভ অন করার জন্য, নতুনদের আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে টি-টোয়েন্টিতেও আমার একই ধরনের চিন্তা। বোর্ডের সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। এটাই সেরা সময় যে টি-টোয়েন্টি থেকেও আমি মুভ অন করি।’ সংক্ষিপ্ত সংস্করণের শেষ ম্যাচটা সাকিব খেলে ফেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে; টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। আর ওয়ানডে! হয়তো আর ৯ ম্যাচই খেলবেন সাকিব! পাকিস্তানের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দিয়ে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ইচ্ছা তার।
আপাতত টেস্ট ছাড়ছেন, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। টেস্টকে বলা হয় ক্রিকেটের মর্যাদাপূর্ণ সংস্করণ। এই সংস্করণে সাকিবের ছবিটা নাকি মিরপুরে বেন স্টোকসকে ফিরিয়ে স্যালুট প্রদর্শনের মতোই। অনেকের মতে, একটু সিরিয়াস হলেই এ সংস্করণের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারও হতে পারতেন তিনি! ৭০ টেস্টে তার কীর্তিগুলোও সেসব কথাই বলে। কিন্তু বিশ্বক্রিকেটে না হোক! সাকিব কি বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অ্যাথলেট? এই বিতর্কেও সবার ওপরে থাকবে তার নাম। লম্বা ক্যারিয়ার, নানা সময় নানা বিতর্ক—সবকিছু ছাপিয়ে যেত মাঠে তার পারফরম্যান্স। একটা হেরে যাওয়া ম্যাচও জিতিয়ে দিতে পারতেন বলেই হয়তো হয়েছিলেন বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ—সাকিব আল হাসান।