তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে জেলা পর্যায়ে হাইটেক পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু হয়। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এরই মধ্যে ৭ বছর কেটে গেছে, কিন্তু কাজ হয়েছে অর্ধেকেরও অনেক কম। এ অবস্থায় নতুন করে মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।
তবে যাচাই-বাছাই শেষে বাস্তবতা বিবেচনায় সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন না করে প্রকল্প কাটছাঁট করার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শে কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রকল্প থেকে কম অগ্রগতি এবং কাজ শুরু হয়নি এমন অনেক খাত বাদ যাচ্ছে। বিশেষ করে কাজ শুরু হয়নি এমন পাঁচটি সিনেপ্লেক্স এবং তিনটি ডরমিটরিসহ কয়েকটি জেলার কাজ বাদ দিয়ে প্রকল্প ছোট করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘জেলা পর্যায়ে আইটি বা হাইটেক পার্ক স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ১২টি জেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়েও সাত বছরের প্রকল্পের অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করতে পারায় সম্প্রতি প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।
সংশোধনী প্রস্তাবনা সূত্রে জানা গেছে, আলোচ্য প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২৫২ কোটি ৪০ লাখ এবং ভারতীয় ঋণে (লাইন অব ক্রেডিট) ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। পরে প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় ৪৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এ পর্যায়ে শুধু সরকারি অংশের অর্থ বেড়েছিল। বর্তমানে প্রকল্পটির ব্যয় আরও ২ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। ফলে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৪ হাজার ১৯৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ হাজার ৭৪৬ কোটি ৭১ লাখ এবং ভারতীয় ঋণের ৬০৫ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সম্প্রতি আলোচ্য প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিইসি সভায় প্রকল্পের বাস্তব অবস্থা এবং বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে খরচ কমাতে হাইটেক পার্ক স্থাপন প্রকল্পটি কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গ বাদ দিয়ে কাটছাঁট করার কাজ শুরু করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
হাইটেক পার্ক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের ডিপিপিতে ছয়টি জেলায় (নাটোর, রংপুর, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ঢাকা) সিনেপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করার কথা ছিল। শুধুমাত্র ঢাকার কেরানীগঞ্জেরটার ছাড়া বাকিগুলোর তেমন কোনো কাজ হয়নি। এ কারণে বাকি পাঁচটি সিনেপ্লেক্স প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া তিনটি জেলায় (নাটোর, রংপুর ও কক্সবাজার) ডরমিটরি ভবন নির্মাণের সংস্থান থাকলেও সেগুলো বাদ দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ডব্লিওডি-সি প্যাকেজের আওতায় কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট জেলায় পাঁচতলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের সংস্থান ছিল। এগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র সিলেট ছাড়া বাকি জেলাগুলোর ক্ষেত্রেও তেমন কোনো কাজ হয়নি। এ কারণে সিলেট জেলারটা রেখে বাকি তিন জেলা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। তবে এই প্যাকেজের অর্থায়ন ভারতের। এ কারণে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
জানা গেছে, এসব খাত বাদ দিয়ে নতুন করে প্রকল্প সংশোধন করে ফের প্রস্তাব পাঠাবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। সেই প্রস্তাবে প্রকল্পের ব্যয় দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা কমে দাঁড়াবে ২ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা এবং ভারতীয় ঋণ ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। যদিও সেটি মূল ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বেশি।
সংশোধনের কারণ হিসেবে প্রকল্প দপ্তর জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় পার্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় জমি বরাদ্দ ও অধিগ্রহণে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব এবং দরদাতাদের অংশগ্রহণের অভাবে পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে হয়েছে। এ ছাড়া, এলওসির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভারত থেকে যে ৬৫ শতাংশ পণ্য আমদানি করা হবে তার কাস্টমস শুল্ক, ভ্যাট এবং আয়কর বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারি খাতে সিডি ভ্যাটে প্রায় ১ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এজন্য ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন।
এ বিষয়ে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক একেএএম ফজলুল হক কালবেলাকে বলেন, পিইসি সভার পরামর্শে প্রস্তাবটি আবার সংশোধন করা হচ্ছে। সরকারি অর্থায়নের খরচ কমাতে কিছু অংশ (কম্পোনেন্ট) বাদ দেওয়া হচ্ছে। এতে খরচ কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে যাবে। এক্ষেত্রে মূলত সরকারি অর্থায়নের খরচ কমানো হবে, বৈদেশিক অর্থায়ন আগেরটাই থাকবে। প্রকল্প কাটছাঁট করার পরও ব্যয় বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পের যে খরচ বাড়বে, সেটা মূলত সিডি ভ্যাট খাতে। কারণ ডিপিপি প্রণয়নের সময় ভুল ছিল। তখন সিডি ভ্যাট কম করে ধরা হয়েছিল। এ কারণে এটা এখন বাড়ছে।
এদিকে, বারবার মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ করতে পারছে না হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত মেয়াদকাল ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় দুই দফায় প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপরও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। ফলে নতুন করে আরও ৩ বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি গড়াচ্ছে ১০ বছরে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণ হিসেবে প্রকল্প পরিচালক জানান, প্রকল্পটি ২০১৭ সালে অনুমোদন হলেও কাজ শুরু হয়েছে মূলত ২০২২ সালের নভেম্বরে। এ কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি খুব বেশি হয়নি। প্রথম চার বছর কাজ শুরু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে আরও তিনজন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। তখন কেন কাজ শুরু হয়নি সেটা আমি বলতে পারব না। তবে যে সময় শুরু হয়েছে, সে হিসাবে অগ্রগতি কম বলা যাবে না।