সরকারের পদত্যাগ দাবিতে একদফার আন্দোলনে মহাসমাবেশের পর রাজধানীর প্রবেশপথে ‘অবস্থান কর্মসূচি’ ছিল বিএনপির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দলটির পরিকল্পনা ছিল, এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলন আরও বেগবান হবে, চাপে পড়বে সরকার; কিন্তু নেতাকর্মীরা ব্যাপকহারে রাজপথে না নামায় ওই কর্মসূচি পুরোপুরি সফল হয়নি বলে দলটির মূল্যায়নে উঠে আসে। এর মধ্য দিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টিও ফুটে ওঠে। এ ঘটনা বিএনপির হাইকমান্ডকে উদ্বিগ্ন ও নাখোশ করে। ফলে আন্দোলন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় হাইকমান্ড। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যর্থতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে এবং চলমান আন্দোলনে গতি আনতে কিছু সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয় দলটি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, সাংগঠনিক ওই পদক্ষেপের (অ্যাকশন) ফলও এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে দল—যার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে গণমিছিলে। এদিকে হাইকমান্ডের কাছে কর্মসূচিতে অঙ্গ ও সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের ব্যর্থতা ধরা পড়লেও ভবিষ্যৎ আন্দোলন বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কায় এখনই ঢালাওভাবে সবার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারছে না দল। এ ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, দলে বৃহত্তর পরিসরে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো কোনো সময় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত, বেদনাদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তার অর্থ এই নয় যে, কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। শৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য দলের হাইকমান্ড সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে হয়তো পুরস্কৃতও করবেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সবারই সজাগ হওয়ার জন্য বোধহয় একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।
জানা যায়, ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে ব্যর্থতার পর একদফার চূড়ান্ত আন্দোলন সফলে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে বিএনপির হাইকমান্ড। এই নীতির আলোকে কর্মসূচিতে দায়িত্বে অবহেলার কারণে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে দিয়ে সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যুবদলের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি এবং অন্য অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসতে পারে বলে জোর আলোচনা আছে। এর মধ্যে মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক পদে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন অনেকে। কারণ, উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান দুর্নীতির একটি মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন। তাকে নিম্ন আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। ফলে তার অনুপস্থিতিতে কাউকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হতে পারে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সরকারবিরোধী ‘অলআউট’ আন্দোলন সামনে রেখে সংগঠনে ‘চেইন অব কমান্ড’ রক্ষায় হাইকমান্ড ছাত্রদল সভাপতিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবদলে নতুন নেতৃত্ব আনেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে তারা দলের নির্দেশনা মানেনি। সে কারণে দল সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে দলের মধ্যে কোনো ইমপ্যাক্ট নেই। বরং আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ও ত্যাগী নেতারা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
তাদের দাবি, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে নেতৃত্বের ব্যাপক প্রতিযোগিতা আছে। ফলে কাউকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিলে সংগঠনে কোনো প্রভাব পড়বে না। নেতাকর্মীরা নতুন নেতার পেছনেই কাজ করবে।
চলমান আন্দোলনে ‘ব্যর্থ’ অবস্থান কর্মসূচির ১৩ দিন পর গত শুক্রবার ঢাকায় ‘গণমিছিল’ ছিল বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মসূচি। হাইকমান্ডের কঠোর অবস্থানে মাথার ওপর সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থার খড়্গ থাকায় ওই কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। গণমিছিল ঘিরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যও দেখা যায়। প্রত্যেকেই যে সরব সেটা প্রমাণে যেন তারা ‘মরিয়া’ ছিল। পাশাপাশি মহানগরের প্রতিটি থানা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা আলাদা ব্যানার নিয়ে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। নিষ্ক্রিয় অনেক নেতাকেও দেখা গেছে গণমিছিলে। অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধরা ছাড়া দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পদধারী নেতাদের কেউই অনুপস্থিত ছিলেন না কর্মসূচিতে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলা থেকে নেতাকর্মীরা যোগ দেন। এটাকে কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিএনপির হাইকমান্ডের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ফল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে মাত্র ‘একটি কর্মসূচি’র ব্যর্থতায় নেতাদের ঢালাওভাবে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেয়নি অনেকে। তাদের যুক্তি, পুলিশ ও সরকারি দলের হামলা-মামলা, নির্যাতন উপেক্ষা করে দলের ঘোষিত কর্মসূচি এসব নেতাদের তত্ত্বাবধানেই বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। কিছুদিন আগে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ নেতৃত্বেই দেশব্যাপী ‘তারুণ্যের সমাবেশ’র কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচিতে তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটেছে বলে দাবি বিএনপির। তা ছাড়া বর্তমানে দায়িত্বে থাকা নেতাদের ঘিরেই আন্দোলন পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। ফলে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে আগামীর আন্দোলনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিএনপির দায়িত্বশীল অনেকে মনে করেন, বৃষ্টি উপেক্ষা করে নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গণমিছিলের কর্মসূচি সফল হওয়া এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘তালিকায় থাকা’ অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে আপাতত সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আপাতত স্থগিত হতে পারে। ছাত্রদল সভাপতি শ্রাবণের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘নিষ্ক্রিয়’ অন্য নেতাদের ‘কঠোর বার্তা’ দিতে চেয়েছিল হাইকমান্ড, যাতে তারা পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে রাজপথে সক্রিয় হয়—গণমিছিলে যার ফল দেখা গেছে।
মন্তব্য করুন