শেখ হারুন
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মিলছে না প্রত্যাশিত বাজেট সহায়তা

অন্তর্বর্তী সরকারের ৫ মাস
প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বড় ধরনের বাজেট সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা। এতে দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় তাদের অর্থ সহায়তা পাওয়ার প্রত্যাশাও বেড়েছিল সরকারের। কারণ সংকটে স্বস্তি দেবে বাজেট সহায়তা। তবে আশ্বাসের মধ্যেই আটকে আছে প্রত্যাশিত অর্থ সহায়তা। বিপুল অঙ্কের অর্থ সহায়তার আশ্বাস থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসে মিলেছে যৎসামান্যই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ উন্নয়ন সহযোগীরা ৭৮০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত এসেছে মাত্র ১১০ কোটি ডলার। এদিকে চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন প্রকল্পে ৮৩০ কোটি ডলার ঋণ ছাড়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যার মধ্যে গত নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে বৈদেশিক ঋণছাড় হয়েছে মাত্র ১৫৪ কোটি ডলার। প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণ সহায়তা রিজার্ভে যুক্ত হলে সরকারের তহবিল ও ডলার সংকট কাটাতে সহায়তা করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন অর্থ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সেখানে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টরা। ওই বৈঠকে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বড় ধরনের বাজেট সহায়তার আশ্বাস পায় সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাজেট সহায়তা পেতে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করছে সরকার। আশা করা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছর ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাজেট সহায়তার বিষয়ে আলোচনা চলছে। আইএমএফ বা তাদের সহায়তায় কম-বেশি ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ও এডিবি ১১০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর থেকে আরও সহায়তা পাওয়া যাবে। উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণছাড় হয়। অর্থবছরের শুরুতে ঋণছাড় কম থাকলেও শেষে বাড়বে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে। রিজার্ভ সংকট কমবে। টাকা-ডলার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আসবে। যে উদ্দেশ্যে এ অর্থ ব্যবহার করা হবে তার একটা সুফল আসবে অর্থনীতিতে, যা অর্থনীতির সামষ্ঠিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে এ ধরনের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রত্যাশিত বাজেট সহায়তার মধ্যে আইএমএফ ৩০০ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংক ১৫০ কোটি ডলার ও এডিবি ১৩৫ কোটি ডলার, এআইআইবি ৪০ কোটি ডলার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০ কোটি ডলার, ওপেক ফান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া ১০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে নতুনভাবে আরও ৭৫ কোটি ডলার ঋণের বিষয়েও ঐকমত্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ও আইমএএফ প্রতিনিধিদল। ফলে আইএমএফের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৪৫ কোটি ডলার। আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারিতে। এরপর তিন কিস্তিতে সংস্থাটি থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ কিস্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে। ২০২৬ সাল নাগাদ পুরো অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং দেশ থেকে আরও বাজেট সহায়তা চায় সরকার। কারণ, এ মুহূর্তে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ কম নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্থানীয় ঋণে সুদ বেশি হওয়ার পাশাপাশি সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের পক্ষে ঋণ পেতে সমস্যা হয়। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের আগ পর্যন্ত বিদেশি উৎস থেকে যত বেশি সম্ভব ঋণ বাড়ানোর কৌশল রয়েছে সরকারের। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বর্তমানের মতো নমনীয় সুদে ঋণ পাওয়া যাবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের নামের পাশে উন্নয়নশীল দেশের তকমা যুক্ত হবে। তখন থেকে নানান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এডিবি, র্যাপিডসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার অনুমান এলডিসি উত্তরণের পর বছরে শুধু পণ্য রপ্তানি বর্তমানের তুলনায় ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ ছাড়া, বিদেশি ঋণের সুদের হার ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। জলবায়ুর অভিঘাতে পরিবেশ সতর্কতা এবং সুশাসনের বিষয়গুলোও সামনে চলে এসেছে। উপরন্তু স্থানীয় রাজস্ব আহরণ কম, রিজার্ভ সংকটসহ সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার সংকট রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এলডিসি থেকে উত্তরণ মসৃণ এবং টেকসই করার ক্ষেত্রে বেশ চ্যালেঞ্জ রয়েছে সামনে।

এদিকে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রতি মাসে যত বিদেশি ঋণছাড় হয়েছে, এর বেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হয়েছে। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৫৪ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ এসেছে। আর সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৭১ কোটি ডলার। বাজেট সহায়তার বাইরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছর ১ লাখ কোটি টাকা বা ৮৩০ কোটি ডলার ঋণছাড়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। অন্যদিকে, এডিপির প্রকল্প সহায়তা হিসেবে বিদেশি সংস্থা ও দেশের কাছে ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতিও মিলছে না। জুলাই-নভেম্বরে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ১০ ভাগের ১ ভাগের সমান। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি এবং অর্থছাড় কমলেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপে রয়েছে সরকার।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, বিদেশি সহায়তা আসছে। কিন্তু প্রকল্পভিত্তিক যেসব ঋণ ছিল, ওইসব ঋণের গতি কিছুটা কমেছে। কারণ দেশে এখনো প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা আসেনি। এজন্য প্রকল্পগুলোতে গতি কম। আর বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব অর্থ সহায়তা আসার কথা ছিল, সেগুলো আসতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতার কারণে পুরোপরি আসছে না। তাই সরকারের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া। যেসব কর্মকর্তা এখনো ঠিক মতো কাজ করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে মোট ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা নিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ দশমিক ৭৬৯ বিলিয়ন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ দশমিক ৫৯৭ বিলিয়ন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া গেছিল। মূলত করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে টিকা কেনা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের বাজেট সহায়তার পরিমাণ বেড়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার বাজেট সহায়তা কার্যক্রম জোরদার করে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পুলিশ ক্যাম্পে হামলাকারীদের ধরতে অ্যাকশনে যৌথবাহিনী

ডাকসুর নারী প্রার্থীদের নিয়ে সাইবার বুলিং, যা বলছেন আলেমরা

ফেসবুকে ‘আল্লাহ হাফেজ বাংলাদেশ’ লিখে বিদেশে পাড়ি, দুদিন পর মৃত্যু

ছাত্রদল নেতাকে চ্যাংদোলা করে থানায় নিয়ে হেনস্তা

গাজায় গণহত্যা ঠেকাতে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের ডাক ইরান-সৌদির

১০২ বছর বয়সে পর্বত জয়, বিশ্বরেকর্ড গড়লেন বৃদ্ধ

৬৭ হাজারে বিক্রি হলো পদ্মার পাঙাশ

রুমিন ফারহানা ইস্যুতে যে আহ্বান জানালেন হাসনাত

২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার সিলেবাস নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পোড়ালে আর রক্ষা নেই, নতুন বিধান

১০

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট মুনাফা সাড়ে ২২ হাজার কোটি

১১

৩ মাসের জন্য ফজলুর রহমানের সব পদ স্থগিত করল বিএনপি

১২

শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনায় পোশাক নিয়ে সমালোচনার মুখে ফারিণ

১৩

বন্ধুর জানাজায় অংশ নিয়ে ভাইরাল সেই সুধীর বাবুর পরলোকগমন

১৪

শোকজের জবাবে যা বললেন ফজলুর রহমান

১৫

শ্বশুরের বিচারপতি হওয়া নিয়ে সমালোচনা, ব্যাখ্যা দিলেন সারজিস

১৬

কর্মক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি আইইবির

১৭

রাকসু নির্বাচন : মনোনয়নপত্র বিতরণের সময় বাড়ল, পেছাবে ভোটের তারিখ

১৮

এসএ২০ লিগের নিলামে বাংলাদেশের ২৩ ক্রিকেটার

১৯

জবি বাংলা বিভাগের এক শিক্ষককে বহিষ্কার, ক্যাম্পাসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা 

২০
X