এক দশক ধরে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর বাংলাদেশে জাতীয় সংক্রামক রোগে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে ভয়ংকর হয়ে দেখা দিলেও বছরের প্রতিটি দিনই কেউ না কেউ রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি বছর রোগটিতে মৃতের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু রোগটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কার্যকর উদ্যোগ নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ থেকে ডেঙ্গু নির্মূল পুরোপুরি সম্ভব নয়। টিকাতেই এর সমাধান। সেদিকে দৃষ্টি দিতে বলেছেন তারা।
ডেঙ্গু একটি প্রাচীন রোগ। চীনের চিকিৎসা-সংক্রান্ত নথিপত্র অনুযায়ী, ৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে রোগটি শনাক্ত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন জানায়, আঠারো এবং উনিশ শতকের দিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজ শিল্পের বিকাশ ঘটায় বন্দর নগরীগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে। তখন ডেঙ্গুর জীবাণুবাহক এডিস ইজিপ্টাই ছড়িয়ে পড়ে। রোগটি শনাক্ত এবং নামকরণ করা হয় ১৭৭৯ সালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারি আকারে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালের দিকে ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডে। বিশ শতকের শেষ ২৫ বছরে রোগটির ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশে রোগটি প্রথম শনাক্ত হয় ২০০০ সালে।
বাংলাদেশে গত আট বছরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে আক্রান্ত হন ২ হাজার ৭৬৯ জন এবং মৃত্যু হয় ৮ জনের। ২০১৮ সালে আক্রান্ত হন ১০ হাজার ১৪৮, মৃত্যু ২৬ জন। ২০১৯ সালে আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪, মৃত্যু ১৬৪ জন। ২০২০ সালে কভিড ভয়াবহতার মধ্যেও রোগটিতে সাতজনের মৃত্যু হয়, আক্রান্ত হন ১ হাজার ৪০৫ জন। ২০২১ সালে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯, মৃত্যু ১০৫ জন। ২০২২ সালে আক্রান্ত হন ৬০ হাজার ৬৩১, মৃত্যু ২৮১ জন। ২০২৩ সালে আক্রান্ত হন ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৪, মৃত্যু ১ হাজার ৬৭৮ জন। ২০২৪ সালে আক্রান্ত হন ৯০ হাজার ৭৯৪ এবং মৃত্যু হয় ৪৬৭ জনের।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, যেহেতু বাহক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না; তাই রোগ নিয়ন্ত্রণই শ্রেয়। যেখানে টিকই হতে পারে উপযুক্ত বিকল্প। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর দুটি টিকা ‘ডেংভাক্সিয়া’ এবং ‘কিউডেঙ্গা’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলেও বাংলাদেশে তা আসেনি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ টিকা দুটি প্রবর্তনের আগে কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারে। সেদিকেও তাদের আগ্রহ লক্ষণীয় নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু এমন একটি রোগ, যা কখনো নির্মূল করা সম্ভব নয়; কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শুধু মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আমাদের দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে টিকাদান হবে উত্তম এবং কার্যকর পন্থা। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়েকটি ডেঙ্গু টিকা ব্যবহার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে একটি পাইলটিং করে অধিকতর উপযুক্ত টিকাটি অনুমোদন করা যেতে পারে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিমুর রশীদ বলেন, ডেঙ্গু টিকার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে টিকা অনুমোদনের বিষয়ে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
ডেঙ্গুর যত টিকা: বর্তমানে বিশ্ববাজারে সব প্রক্রিয়া সম্পন্নের পথে এমন দুটি টিকা রয়েছে। টিকাগুলোর এখনো ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেনি। এর একটি হলো ফ্রান্সের সানফি পাস্তুরের প্রস্তুতকৃত ‘ডেংভাক্সিয়া’। এটি লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড প্রযুক্তির টিকা, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রকারের বিরুদ্ধে কার্যকরী হতে পারে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। এটি ইয়েল ফিভার ভাইরাসের (ওয়াইএফভি) বংশোদ্ভূত একটি ভাইরাস থেকে তৈরি করা হয়েছে, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনগত উপাদান ধারণ করে।
অন্যটি ‘তাক-০০৩’ বা ‘কিউডেঙ্গা’। প্রস্তুতকারক জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালস। এটি লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড টিকা। গবেষণাকালীন নাম ছিল তাক-০০৩, যা একটি শনাক্তকারী সংখ্যা। বাজারজাতকরণের সময় নামকরণ হয় কিউডেঙ্গা। এটিও ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে সক্ষম। এই টিকাটিও ওয়াইএফভির অনুরূপ একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তৈরি, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের কিছু জিন ধারণ করে এবং শরীরে প্রতিরোধ তৈরি করতে সাহায্য করে।
টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা: সানফি পাস্তুর উদ্ভাবিত ডেংভাক্সিয়া যেটি প্রথমে বাজারে আনা হয়েছিল, সেটি শুধু যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছিল, তাদের জন্য কার্যকর। যাদের আগে ডেঙ্গু হয়নি, তাদের ক্ষেত্রে এই টিকা দেওয়ার পর ভবিষ্যতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে গুরুতর রূপ দেখা দিতে পারে। এই কারণে স্যানোফির এ টিকাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সতর্কবার্তা পেয়েছিল। টিকাটি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এটি ফ্রিজ করা অর্থাৎ শূন্য ডিগ্রি বা তার নিচে সংরক্ষণ করা যাবে না। এমনকি বিতরণের সময়ও তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ জরুরি। উষ্ণ বা অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশে রাখলে টিকার কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
অন্যদিকে জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালস উদ্ভাবিত কিউডেঙ্গা টিকার ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে, যা ‘টেট্রাভ্যালেন্ট ইমুনাইজেশন অ্যাগেনস্ট ডেঙ্গু ইফিসিয়েন্সি স্টাডি’ নামে পরিচিত। এই পরীক্ষায় দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার ডেঙ্গু-এন্ডেমিক অঞ্চলজুড়ে ৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী ২০ হাজারের বেশি শিশু অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারীরা কিউডেঙ্গার দুটি ডোজ প্রথম দিন এবং ৯০তম দিনে পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় ডোজের পরে ১২ মাসের ফলো-আপ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে ৮০ দশমিক ২ শতাংশ টিকার কার্যকারিতা দেখা গেছে। এই টিকাটিও দুই থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। উষ্ণ বা অতিরিক্ত ঠান্ডা পরিবেশে রাখলে টিকার কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ার ‘ন্যাশনাল এজেন্সি ফর ড্রাগ অ্যান্ড ফুড কন্ট্রোল’ ২০২২ সালের আগস্টে ৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের জন্য কিউডেঙ্গা অনুমোদন করেছে, যা টিকা অনুমোদনকারী প্রথম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। পরবর্তীকালে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। ২০২৪ সালের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিউডেঙ্গাকে প্রাক-যোগ্যতা (প্রিকোয়ালিফাই) প্রদান করে এবং ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারের সুপারিশ করে। প্রাক-যোগ্যতা এটিকে ইউনিসেফ এবং প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের মতো জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর দ্বারা সংগ্রহের জন্য যোগ্য করে তোলে।
কিউডেঙ্গা টিকা ৩ মাসের ব্যবধানে মাংসপেশিতে ইনজেকশনের মাধ্যমে ২ ডোজে দেওয়া হয় এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ থেকে রক্ষা করে। উচ্চ সংক্রমণের হার সম্পন্ন অঞ্চলে ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের ব্যবহারের জন্য কিউডেঙ্গা টিকাকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে থাকা দেশগুলোসহ বেশ কয়েকটি দেশে এটি অনুমোদিত হয়েছে।