নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র প্রধান বা আমির কে, তা নিয়ে ধন্দে পড়েছেন খোদ পুলিশের তদন্তকারীরাও। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ওই আস্তানা আবিষ্কারের পর এ পর্যন্ত সংগঠনটির ১৭ সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তাদের মধ্যে নাটোরের ২৮ বছর বয়সী তরুণ জুয়েল মাহমুদ ওরফে হাবিবুল্লাহ ওরফে আব্দুল আহাদ মেন্দি নিজেকে আমির দাবি করেন। সংগঠনে তাকে ‘কমান্ডার মেন্দি’ নামে ডাকা হয়। এই তরুণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, রিমান্ডে থাকা জুয়েল মাহমুদ ওরফে কমান্ডার মেন্দি দাবি করছেন, তার নামেই ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ চলছে। তার ডাকে সাড়া দিয়েই ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ প্রতিষ্ঠায় কুলাউড়ায় আস্তানায় লোকজন এসেছে, ইমাম মাহাদীর আগে এই যুদ্ধের নেতৃত্বও তার হাতে! কিন্তু ওই সংগঠনটির বিস্ফোরকের মজুত, অর্থের জোগান এবং সার্বিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে যে, শারীরিক প্রতিবন্ধী পঙ্গু এই ব্যক্তির মাধ্যমে এমন আয়োজন হতে পারে না। অবশ্য কমান্ডার মেন্দি দাবি করছেন, ইমাম মাহাদীর আগে শারীরিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির এক লোকের আবির্ভাব এবং গাজওয়াতু হিন্দের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। তিনিই শারীরিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির সেই লোক!
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ডিসি এস এম নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, জুয়েল মাহমুদের দেওয়া তথ্য এখনই তারা বিশ্বাস করছেন না। তারা মনে করছেন, তাকে সামনে নিয়ে সংগঠনটি এগোলেও পেছনে অন্য কেউ রয়েছে। সংগঠনটির আমির বা প্রধানও অন্য কেউ হতে পারে। পুরো বিষয়টি তদন্ত চলছে এবং এটি উদঘাটন বেশ সময়ের প্রয়োজন।
এই কর্মকর্তা বলেন, জুয়েলকে গ্রেপ্তারের পরও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও অন্তত পাঁচটি পরিবার নিখোঁজ হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। একটি সংগঠনের প্রধানকে গ্রেপ্তারের পর তো এভাবে কারও ‘হিজরত’ করা বা ঘর ছাড়া সম্ভব নয়। এ জন্য নানা বিষয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে এবং এই সন্দেহগুলো দূর করতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন ওই সংগঠনটিতে অনেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে বোঝাও যাচ্ছে না যে, কেউ নিখোঁজ রয়েছে কি না। একটি পরিবারের একক কেউ উগ্রবাদে জড়িয়ে ঘর ছাড়লে পরিবারের অন্য কেউ জিডি করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুরো পরিবার চলে যাওয়ায় দ্রুত সবকিছু জানা সম্ভব হচ্ছে না।
কারাগার থেকে বাইয়্যাত নেন কমান্ডার মেন্দি : সিটিটিসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুয়েল মাহমুদ ওরফে কমান্ডার মেন্দির বাড়ি নাটোরে। উগ্রবাদের জন্য তিনি ২০১৮ সালে একবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কয়েক মাস কারাভোগের পর বেরিয়ে এসেই ঘর ছাড়েন। জিজ্ঞাসাবাদে ওই ব্যক্তি দাবি করেন যে, কারাগারে থাকা অবস্থায় অনেকের সঙ্গে গাজওয়াতুল হিন্দ নিয়ে আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় সবাই তাকে ইমাম মাহমুদ হিসেবে মেনে নেন এবং কারামুক্ত হয়ে পাহাড়ে গিয়ে গাজওয়াতুল হিন্দের নেতৃত্ব নিতে বলেন। কারাগার থেকে তিনি বাইয়্যাত নেন।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, জুয়েল মাহমুদের এসব ভাষ্য গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, কারাবন্দি কোনো জঙ্গি বা জঙ্গি সংগঠনের নেতার উসকানিতে তাকে সামনে রেখে নতুন প্ল্যাটফর্ম এগিয়ে যাচ্ছিল। একটি জায়গায় গিয়ে তারা ভিন্ন কিছু চিন্তা করত হয়তো।
কোয়েলের মাধ্যমে ওমান থেকে আসে টাকা : সিটিটিসি বলছে, কুলাউড়ার কর্মধার এলাকায় ৫০ শতক জমি কিনে চারটি আস্তানা তৈরি করেছিল ইমাম মাহমুদের কাফেলার জঙ্গিরা। এ ছাড়া একই এলাকার গহিন কালাপাহাড়েও কেনা হয়েছিল জমি। সেখানে ছাগল ও ভেড়া পালানোর প্রস্তুতি চলছিল। ওই দুই আস্তানা থেকে কয়েক লাখ টাকার মজুত করা খাদ্য, টাকা ও বিস্ফোরক জব্দ করা হয়। এ থেকে সন্দেহের সৃষ্টি হয়, সংগঠনটির আয়ের উৎস নিয়ে। সেই উৎস খুঁজতে গিয়ে এখন পর্যন্ত জানা গেছে, যারা ঘর ছেড়েছেন তারা নিজেদের সহায়-সম্বল বিক্রি করে সংগঠনে টাকা জমা দিয়েছেন। তবে গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে কোয়েল ওরফে জামিলের কাছে থেকে জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওই জঙ্গি জানিয়েছে যে, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে টাকা পাঠাতেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ডিসি নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, কোয়েল ওরফে জামিল এক সময়ে ওমান থাকতেন। সেখানে তার আয় করা সব টাকাই সংগঠনে দিয়েছেন। পাশাপাশি সেখানে সংগঠনের জন্য একটি শুভাকাঙ্ক্ষী গ্রুপও তৈরি করেছেন বলে জানিয়েছেন। তারাই মূলত টাকা পাঠাত বলে জানা যাচ্ছে। সংগঠনটির অর্থনৈতিক বিষয়ে তদন্ত চলছে।
চীন থেকে ফিরেই দুই মেধাবী প্রকৌশলী চলে যান আস্তানায়!: গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে গাইবান্ধার চাদপাড়ার রাহাত মণ্ডল (২৪) এবং মাদারীপুরের মেহেদী হাসান মুন্না (২৩) রয়েছেন। তারা দুজনই পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ছাত্রজীবনে ছিলেন অতিমেধাবী। দুজনই চীনা সরকারের পূর্ণকালীন বৃত্তি নিয়ে দেশটিতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যান। কিন্তু মাসখানেক আগে দেশে ফিরেই চলে যান কালাপাহাড়ের আস্তানায়! এখন সিটিটিসির রিমান্ডে রয়েছেন এ দুই মেধাবী প্রকৌশলী।
সুন্দর জীবন ছেড়ে পাহাড়ের মতো জায়গায় অবস্থানের বিষয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা দাবি করছেন, মূলত কালাপাহাড় থেকেই গাজওয়াতুল হিন্দ (উপমহাদেশে ধর্মীয় যুদ্ধ) শুরু হবে। ওই এলাকাটি থাকবে নিরাপদ। তাদের কিছুই হবে না। এ জন্যই তারা ‘নির্দেশ’ পেয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, মাসখানেক আগে রাহাত বিমানবন্দরে নেমে বাসায় না গিয়ে সোজা চলে যান আস্তানায়। তার পরিবার জানত না, তিনি দেশে ফিরেছিলেন। মেহেদী বাড়ি ফিরলেও কাউকে না জানিয়ে আস্তানায় চলে যান। তার স্বজনরা এ নিয়ে থানায় জিডি করেছিলেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এই মেধাবীদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে, তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত জুয়েল মাহমুদকে ইমাম মাহমুদ ভেবে কাঁধে নিয়ে চলতেন। ভাবতেন, তাকে সেবা করলে নাকি ভালো থাকা যাবে!
মন্তব্য করুন