জাফর আহমেদ
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৮:৫২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি কাজ অনুযায়ী

বঙ্গবন্ধুসহ চার শতাধিক নেতা
মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি কাজ অনুযায়ী

‘মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ বা এমপিএ) মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করা হচ্ছে’—একটি গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশ হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান অনেকে। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের (জামুকা) মহাসচিব শাহিনা খাতুন কালবেলাকে জানিয়েছেন, খবরটি আদৌ সত্য নয়। রাজনৈতিক নেতাদের স্বীকৃতি বাতিল হচ্ছে না। বরং তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে যেই কাজ করেছেন বা ভূমিকায় ছিলেন, সেই অনুযায়ী তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

গত ১০ মার্চ জামুকার ৯৪তম সভায় একটি প্রস্তাব ওঠে। সংশোধনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি আরও চার শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধার ‘মুক্তিযোদ্ধার সহযোগী’ হিসেবে নতুন পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। এই চার শ্রেণি হলো—যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছেন এবং বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন; যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূতসহ অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের সময় প্রণীত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা বলতে যে কোনো ব্যক্তি, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বের এক গেজেটের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা করা হলে এর পরিধি বিস্তৃত হয়। পরে তা জাতীয় সংসদেও পাস করে তৎকালীন সরকার। সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তারাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’

সংজ্ঞায় রণাঙ্গনের সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মী, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রবাসে পেশাজীবী সংগঠক, ভারতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য, পাকিস্তান বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত নারী (বীরাঙ্গনা), মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসা প্রদানকারী চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এবার সেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সংশোধনের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। এ-সংক্রান্ত খসড়ায় পরিবর্তিত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থ যাহারা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন—এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক ওই সময়ে যাদের বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে ছিল এবং সশস্ত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর), নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স এবং আনসার সদস্য, তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।

খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞাও পরিবর্তন করা হয়েছে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

অথচ বিদ্যমান আইনের সংজ্ঞায় বলা রয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিস কমিটির বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ষষ্ঠ দফার চূড়ান্ত (সমন্বিত) তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৮ হাজার ৮৫১ জন। এর মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ১০ হাজার ৯৯৬ জন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১৪ আগস্ট নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই করে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম কালবেলাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার শতাধিক রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করা হয়নি। তিনি বলেন, এসব কি বদলানো যায়! যারা রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। তারা তো মুক্তিযুদ্ধের পরই সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু যারা বড় বড় নেতা এবং যাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তাদের কি অস্বীকার করা যায়। তাই তাদের স্বীকৃতি বাতিল করা নয়। যার যার অবস্থান থেকে তাদের সম্মানিত করা। কারও কোনো সম্মান খাটো করা নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক-ই-আজম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ—তারা তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত না। তারা প্রবাসী সরকার হিসেবে স্বীকৃত। তাই তাদের প্রবাসী সরকার হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হবে। বিষয়টি আমরা প্রস্তাব করেছি, কিন্তু এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। এই প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদে যাবে। আলোচনার মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত হয় সেটাই চূড়ান্ত হবে। তাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে, বিষয়টি সঠিক নয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শিল্পী ও যারা ফুটবল দল খেলেছেন তাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন কালবেলাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার শতাধিক রাজনীতিবিদের বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে, বিষয়টি সঠিক। সভায় প্রস্তাব করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে যেই কাজ করেছেন বা ভূমিকায় ছিলেন, সেই অনুযায়ী তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা এ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কালবেলাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি সামরিক যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধে সবার অংশগ্রহণ ছিল। আমি মনে করি সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে সামরিক শাসন বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এদেশে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করে গেছে, এখন বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় নিউমার্কেটে দোয়া মাহফিল

পরিবার সঞ্চয়পত্র নিয়ে যা যা জানা দরকার

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মিলল নিরাপত্তা প্রহরীর মরদেহ

নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বার্তা প্রেস সচিবের

তৃতীয় বিয়ে করায় স্বামীকে শিকলে বেঁধে রাখলেন স্ত্রী

চলন্ত গাড়ির ছাদে তরুণ-তরুণীর কাণ্ড ভাইরাল

দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দিনাজপুরে

সাগরে গভীর নিম্নচাপ, শীত নিয়ে নতুন বার্তা

ডিসেম্বরের এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ কবে, জানাল কমিশন

টিফিনের টাকায় রাশিয়ান মিগ-২৯ আদলে ‘বিমান’ বানালেন হাসিব 

১০

দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের যুক্ত রেখেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে : মির্জা ফখরুল

১১

অক্সিজেন লাগছে খালেদা জিয়ার, প্রস্তুত রাখা হয়েছে আইসিইউ 

১২

বিশ্বের নামিদামি যেসব তারকা দল পাননি বিপিএলে

১৩

এশিয়ার বন্যায় ১ হাজার প্রাণহানি, সেনাবাহিনী মোতায়েন

১৪

এবার যুদ্ধবিমানে শক্তিশালী হচ্ছে তেহরান, কী কৌশলে এগোচ্ছেন খামেনি

১৫

খুলনায় চলছে ৮ দলের সমাবেশ

১৬

সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পথে স্পিডবোট ডুবি, মা-মেয়ের মৃত্যু

১৭

মেট্রোরেলের যাত্রী কমলো ১০ শতাংশ : ডিএমটিসিএল এমডি

১৮

‘মানসিক চাপ’ উল্লেখ করে এনসিপি ছাড়লেন রাঙামাটির প্রধান সমন্বয়ক

১৯

পূর্বাচলে শেখ রেহানার প্লট বরাদ্দ বাতিলের নির্দেশ আদালতের

২০
X