শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:২১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ক্রিকেটে ‘গ্রোভেল’ কী — এবং কেন এটি এত কুখ্যাত?

৪৯ বছর আগের সেই বিতর্ক আবার উন্মুক্ত করলেন প্রোটিয়া কোচ। ছবি : সংগৃহীত
৪৯ বছর আগের সেই বিতর্ক আবার উন্মুক্ত করলেন প্রোটিয়া কোচ। ছবি : সংগৃহীত

ক্রিকেট মাঠে কিছু শব্দ থাকে, যা সময় পেরিয়ে গেলেও খেলার ইতিহাসে দগদগে ক্ষত হয়ে থাকে। ঠিক সেরকমই একটি শব্দ—“গ্রোভেল”বা “নীচু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা” । একবার উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে এটি শুধু মাঠের প্রতিপক্ষকে উসকে দেয়নি, বরং ক্রিকেটের ভেতর-বাইরের সামাজিক অনুভূতিকেও তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছিল। প্রায় পাঁচ দশক পর ভারতের বিপক্ষে গৌহাটি টেস্টের চতুর্থ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ শুক্রি কনরাডের মন্তব্যে যে শব্দটি আবার উঠে এসেছে, তার শেকড় লুকিয়ে ইংল্যান্ড অধিনায়ক টনি গ্রেইগের ১৯৭৬ সালের এক অভিশপ্ত মন্তব্যে। আজও যে ঘটনার রেশ অম্লান। ক্রিকইনফোর করা প্রতিবেদন থেকে কালবেলার পাঠকদের জন্য ‘গ্রোভেলের বিতর্কিত ইতিহাস ব্যাখা করা হল ।

টনি গ্রেইগের সেই কথা, যা বদলে দিয়েছিল একটি সিরিজের গতি

১৯৭৬ সালের ইংল্যান্ড–ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের আগের দিন। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে রীতিমতো বিরক্তি নিয়ে ইংল্যান্ড অধিনায়ক টনি গ্রেইগ বলেছিলেন—

ওদের আমরা গ্রোভেল করাবো।

শব্দটি উচ্চারিত হতেই যেন ক্যারিবীয় শিবিরে আগুনে ঘি পড়ল। ব্যাট-বলের লড়াইয়ের আগে সামাজিক-ঐতিহাসিক ক্ষতচিহ্নে হাত দিয়ে বসলেন গ্রেইগ—তিনি ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান, আর তার টার্গেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের একঝাঁক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার।

টনি গ্রেইগের সেই কথাই তাঁতিয়ে দিয়েছিল ক্যারিবীয়দের।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড তখনই বলে দিয়েছিলেন,

একজন কৃষ্ণাঙ্গের কাছে ‘গ্রোভেল’ শব্দটি রক্ত গরম করে দেয়। আর এটা যদি একজন দক্ষিণ আফ্রিকান বলে, তখন তা আরও অপমানজনক।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে মুহূর্তেই জন্ম নিল নতুন আগুন। তরুণ ভিভ রিচার্ডস পরে বলেছিলেন—

গ্রেইগ আমাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা দিয়ে ফেলেছিলেন।

স্রেফ কথা নয়—সিরিজের প্রতিটি মুহূর্তে গ্রেইগের মূল্য চুকাতে হয়েছিল

সিরিজ শুরুর পরপরই দেখা গেল, গ্রেইগের মন্তব্য মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গতি-বোলারদের রীতিমতো দানবে পরিণত করেছে।

অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, ওয়েন ড্যানিয়েল, ভ্যানবর্ন হোল্ডার—সবাই যেন আগুন ছুড়ছিল।

সে বছরের গ্রীষ্ম ছিল তীব্র উত্তপ্ত, আর ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ছিল ভঙ্গুর। ওল্ড ট্রাফোর্ড আর হেডিংলির পরাজয় যেন ইংল্যান্ডকে ভেঙে টুকরো করে দিল।

এদিকে দর্শক গ্যালারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকদের কোলাহল পরিণত হয়েছে সঙ্গীত, স্লোগান আর প্রতিশোধের উল্লাসে। লন্ডনের দ্য ওভালে পরিবেশ ছিল যেন দক্ষিণ লন্ডনেরই কোনো ক্যারিবীয় উৎসব।

গ্রেইগ ব্যাট হাতে নামলেই শুরু হত ঠাট্টা-উপহাস। এক পর্যায়ে যখন মাইকেল হোল্ডিং তাকে বোল্ড করে দিলেন, দর্শকদের একটি দল মাঠে নেমে এসে তাকে বিদ্রূপ করতে শুরু করেছিল—যা উইজডেন পর্যন্ত “লজ্জাজনক দৃশ্য” হিসেবে উল্লেখ করেছে।

অবশেষে ‘গ্রোভেল’ করলেন গ্রেইগই—বড় স্ট্যান্ডে হাঁটু গেড়ে

ওভাল টেস্টের চতুর্থ দিনে দুপুরের তাপে গ্যালারি যখন উল্লাসে ফেটে পড়ছে, তখন টনি গ্রেইগ ধীরে ধীরে হার্লিফোর্ড রোডের ওপেন স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটলেন এবং সেখানে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন—ঠিক সেই শব্দের প্রতীকী প্রকাশ করলেন, যা তিনি প্রথম দিনে উচ্চারণ করেছিলেন।

গ্যালারি তখন যেন বিস্ফোরিত।

গ্রেইগ বলেছিলেন,

শুরুতে ভুল করেছিলাম। এই সমর্থকরা আমাকে ভুলে যেতে দেয়নি।

পরদিন হোল্ডিং ৬ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে গুঁড়িয়ে দিলেন। সিরিজ শেষ, প্রতিশোধও শেষ। গ্রেইগের জন্য পরিণতিটা অবশ্য করুণ।

সিরিজ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মাস পর গ্রেইগ কেরি প্যাকার বিপ্লবে যোগ দেন। ইংল্যান্ড তার নেতৃত্ব কেড়ে নেয়। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয় দ্রুতই।

পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার হন, তবে বিতর্ক থেকে কখনও পুরোপুরি দূরে থাকেননি। ক্যারিবীয় সিরিজে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে বাউন্ডারির পরে তার “গুডনাইট চার্লি” মন্তব্য নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল।

গ্রেইগ বহু বছর পর বলেছিলেন,

যারা আমার ‘গ্রোভেল’ মন্তব্যে বর্ণবাদ খুঁজে পায়, তারা আমাকে চেনে না। আমি শুধু ভুল সময়ে ভুল কথা বলেছিলাম।

তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অনেকের মতে, সেই মন্তব্যই ছিল তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।

কেন আজও ‘গ্রোভেল’ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত শব্দগুলোর একটি?

কারণ এটি কেবল খেলার ভাষা ছিল না। এটি প্রতিফলিত করেছিল ঔপনিবেশিক অতীত, বর্ণবাদী স্মৃতি, এবং সেই ক্ষতগুলিকে গ্রেইগ আবার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

আর প্রতিক্রিয়া? ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইতিহাসের সেরা বোলিং ব্যাটারি দিয়ে এক পুরো দেশকে দেখিয়ে দিয়েছিল—কেউই আর কখনও ‘গ্রোভেল’ করবে না।

মূল প্রতিবেদন : মার্টিন উইলিয়ামসন (ESPNcricinfo)

অনুবাদ : নুরসাদ আমিন

তথ্যসূত্র

  • Grovel, ডেভিড টসেল (২০০৭)
  • I Don't Bruise Easily, ব্রায়ান ক্লোজ (১৯৭৮)
  • My Story, টনি গ্রেইগ ও অ্যালান লি (১৯৮০)
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টানা ৯ ঘণ্টা সিলেটের যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ থাকবে না শনিবার

রাতের আঁধারে যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘ডিটওয়াহ’

ধানের শীষের জাগরণে ঐক্যবদ্ধ গণমিছিল

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল পুলিশ সদস্যসহ ২ জনের

রাজশাহীতে ৬০ হারানো ফোন ফিরিয়ে দিল পুলিশ

বাঙলা কলেজ ছাত্রদলের ৪ নেতা বহিষ্কার

চবিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘সামুদ্রিক মৎস্য ও নীল উদ্ভাবন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন

অবৈধ ফোন বেচাকেনা নিয়ে বিটিআরসির নির্দেশ

সংরক্ষিত বনের গাছ বিক্রির অভিযোগ বিট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে

১০

আইপিএলে দল পেলেন না বাংলাদেশের কেউই

১১

‘১০ লাখ মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর একই’

১২

প্রতিবন্ধী নারীর ভাতার টাকা যায় আ.লীগ নেতার পকেটে

১৩

নির্বাচন করবেন কি না জানালেন প্রেস সচিব

১৪

আবারও পেছাল বিপিএল

১৫

যে গ্রামে শত বছর ধরে টিকে আছে শাঁখারি শিল্প

১৬

শয়তানের নিশ্বাস ছড়িয়ে ধর্ষণ

১৭

স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ইয়াবা পাচারকালে ধরা

১৮

মগবাজারে বহুতল ভবনে আগুন

১৯

ফজলুর রহমানের বাসার সামনে ককটেল বিস্ফোরণ

২০
X