বীর সাহাবী
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ১২:১৩ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার আরও তলানিতে

অস্তিত্ব সংকটে ব্রোকারেজ হাউসগুলো
রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার আরও তলানিতে

৫ আগস্টের পর শুরুটা হয়েছিল নতুন কিছুর প্রত্যয়ে। আর এ আশায় দেশের প্রতিটি খাতের শীর্ষ পদগুলোতেও নতুন মুখ আসে। অন্যান্য খাতে প্রত্যাশিত পরিবর্তন ও তার প্রতিফলন কিছুটা দেখা গেলেও তার ছিটেফোঁটারও দেখা মেলেনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি)। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্থাটির দায়িত্ব দেওয়া হয় খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কাছে। তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে যুক্ত হয়ে নতুন দুজন কমিশনার ও একজন পুরোনো কমিশনার নিয়ে যাত্রা শুরুর ৯ মাস পরও আশানুরূপ অগ্রগতি নেই পুঁজিবাজারে। উল্টো আরও তলানিতে নামছে বাজার পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যর্থতার সব সীমা পার করে ফেলেছেন উনি। দিন দিন নিঃস্ব হয়ে বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নামছেন। এতে বাজারের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে সব মহলে। তবে আশার কথা হলো, পুঁজিবাজারে স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি রুখতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসে তিন মাসের মধ্যে পুজিবাজার সংস্কারের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, পুঁজিবাজার নিয়ে ‘এক্সপার্ট’ বা অভিজ্ঞ কাউকে এ দায়িত্বে দেওয়া দরকার ছিল। যিনি বাজারের বিনিয়োগকারীদের পালস বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু আমরা দেখলাম রাশেদ মাকসুদ যোগদানের পরপরই পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে তাকে অপসারণ করার দাবি ওঠে। প্রথমে কেউ এতে কর্ণপাত না করলেও দিন দিন বাজার পরিস্থিতি খারাপের সঙ্গে বিএসইসি চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি আরও জোরালো হতে থাকে। দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাস হলেও এখনো তিনি কোনো দৃশ্যমান সংস্কার করতে পারেননি।

নিজের ঘরেও অনাস্থার সার্টিফিকেট পেয়েছেন রাশেদ মাকসুদ

রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কমিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার সব বুমেরাং হয়েছে। রাশেদ মাকসুদ পুরো কমিশনকেই তার বিপরীত অবস্থানে নিয়ে গেছেন।

কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, তিনি যোগদানের পর প্রথম কাজ ছিল কমিশনের অফিসারদের তার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। সবার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যারা একদম চিহ্নিত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের শাস্তি দেওয়া। কিন্তু তিনি যোগ দিয়েই সবাইকে শোকজ নোটিশ দেওয়া শুরু করেছেন। প্রত্যেক কর্মকর্তার মনে আতঙ্ক তৈরি করেছেন। এতে সবাই দাপ্তরিক কাজ করার চেয়ে চাকরি হারানোর ভয়েই ব্যয় করেছেন বেশি সময়।

বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে তারা আরও বলেন, প্রথমে ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তারা জামিন পাওয়ার পর সবশেষ ২১ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া। তার এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনাস্থা আরও বেড়েছে।

‘রাশেদ মাকসুদের অপসারণেই ঘুরে দাঁড়াবে বাজার’

সাজিদুল ইসলাম নামে এক বিনিয়োগকারী কালবেলাকে বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে পুঁজিবাজারে কারসাজির মাধ্যমে বাজার থেকে অনেক টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার জমানো সব সঞ্চয় বাজারে বিনিয়োগ করেছিলাম, যা প্রায় শেষের পথে। ফ্যাসিস্টের পতনের পর ভেবেছিলাম বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু রাশেদ মাকসুদ আসার পর বাজার আরও তলানিতে গেছে। তার অপসারণ না হলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না।

বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমআই) সভাপতি এস এম ইকবাল কালবেলাকে বলেন, আমরা আশাবাদী ছিলাম যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা নিজে পুঁজিবাজার নিয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন, তাহলে বাজার ভালো হবে। কিন্তু ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য অংশীজন যার (বিএসইসি চেয়ারম্যান) অপসারণ চান, তাকে প্রধান উপদেষ্টার সভার উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রশ্ন উঠেছে, যা এই দেশের জন্য, জাতির জন্য ও বিনিয়োগকারীদের জন্য কলঙ্কের বলে আমি মনে করি। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম যারা দুর্নীতির মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে বিনাশ করে দিয়েছেন তাদের শাস্তি হবে।

৯ মাস ধরে পুঁজিবাজারে বন্ধ রয়েছে পুঁজি সংগ্রহের পথ

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গত বছরের এপ্রিলে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আর কোনো আইপিও অনুমোদন দেননি। আর ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিএসইসির দায়িত্ব নেওয়া খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কমিশনও গত ৯ মাসে কোনো আইপিও অনুমোদন করেনি। ফলে দীর্ঘ এ সময় ধরে পুঁজিবাজারে বন্ধ রয়েছে পুঁজির জোগান। পুঁজির জোগান না দিলেও এ সময়ে ১৫টির বেশি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করা হয়েছে বলে বিএসইসি ও ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে। দীর্ঘ এ সময় ধরে আইপিও অনুমোদন না হওয়ায় পুঁজিবাজারে স্বাভাবিকতা ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বাজার মূলধন কমেছে সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি, সূচক কমেছে ৯০৪ পয়েন্ট

রাশেদ মাকসুদ কমিশন গত বছরের ১৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে বাজার মূলধন কমার পাশাপাশি সূচকও কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন ৪৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ কোটি টাকায়। গত ১৮ আগস্ট বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এদিকে গত ১৮ আগস্ট ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৭৭৮ পয়েন্ট, যা ৯০৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৭৪ পয়েন্টে। বাজার মূলধন ও সূচক কমার পাশাপাশি কমেছে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণও।

অস্তিত্ব সংকটে ব্রোকারেজ হাউসগুলো

দৈনিক লেনদেনে খরা লাগায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশের ব্রোকারেজ হাউসগুলো। তাদের কর্মীদের ছাঁটাই করাসহ নিজেদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক ব্রোকারেজ হাউস। বিআরবি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আলমগীর হোসেন কালবেলাকে বলেন, উনি শত শত কোটি টাকা জরিমানা করেছেন যার এক টাকাও আদায় হয়নি আর হবেও না। এ ছাড়া কিছু অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছেন এগুলো একটিও সংস্কারের অংশ নয়। অনেকেই অপরাধ করেছেন, কিন্তু যে জরিমানা করা হয়েছে, তা হাস্যকর। কখনোই তা আদায় হবে না। উনার অপ্রতিরোধ্য সিদ্ধান্তগুলো সব বুমেরাং হয়েছে। উনি এক জায়গায় সফল তা হচ্ছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর ঘুম কেড়ে নিয়েছেন আর আমার মতো যারা চাকরি করে খাচ্ছেন তাদের বেকার করছেন। আমার অফিস থেকে নির্দেশ দিয়েছে কর্মী ছাঁটাই করার। এখন আমার নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে হলেও আমার কর্মীদের বাঁচাতে হবে। এভাবেই চলছে বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউস।

অংশীজনের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্যের কোঠায়

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক শাকিল রিজভী কালবেলাকে বলেন, যে জায়গাগুলোয় সংস্কার হওয়া দরকার সেখানে হাত দিচ্ছে না। সমস্যাগুলো যে জায়গা তা অনেক আগেই স্টক এক্সচেঞ্জ বলে দিয়েছে, কিন্তু সেখানে কোনো হাত দেওয়া হচ্ছে না। বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সমস্যা কোথায়। আমরা তো বলে দিয়েছি সমস্যা কোথায়। সেটা আমলে নিয়ে কাজ না করলে বাজার কীভাবে ভালো হবে। যদি সেগুলো করার পরও বাজার ভালো না হতো তখন না হয় বুঝতাম আমাদের দেওয়া পরামর্শ ভালো ছিল না।

ডিএসইর আরেকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ডিএসইসি চেয়ারম্যান বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ। বাজারের যারা অংশীজন রয়েছেন তাদের সঙ্গে চেয়ারম্যানের যোগাযোগ একদম শূন্য বলা চলে। তিনি নিজেকে বাজার থেকে আইসোলেটেড করে রেখেছেন। যদি বাজার ভালো হতো তাহলে এটা মেনে নেওয়া যেত। বাজার ভালো না হওয়ায় দায়ভার আরও বেড়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাজার সম্পর্কে যে তার একেবারেই ধারণা নেই তার প্রমাণ হচ্ছে তিনি একে একে যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা সব ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। ডিএসইর বোর্ড তৈরি করার সময়ই উনার অপরিপক্বতা এবং উনার অভিজ্ঞতার দৈন্যদশা ফুটে উঠেছে। ডিবিএ তাকে টাস্কফোর্স করতে বললেও তিনি নিজের মতো করে টাস্কফোর্স করে গত ৯ মাসে কোনো কিছুই প্রোডাকশন করতে পারেননি। টাস্কফোর্স সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বিতর্কিত দুজন লোক দিয়ে। তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সম্পূর্ণ অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। ফলে পুরো কমিশন তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গৃহবন্দি করে রাখে। এটা ছিল তারই ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। পুরো কমিশনকে তার ব্যক্তিগত আক্রোশের মাধ্যমে ২১ জন লোককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা পুরোপুরি অদ্ভুত বিষয়। তিনি একটি আইপিও বাজারে আনতে পারেননি। ডিবিএর উদ্যোগে বাজার অংশীজন নিয়ে একটি বৈঠক করা হলে সেখানে ডিবিএ থেকে যে ছয়জন বক্তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে উনি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচজন বক্তাকে নিষেধ করেন এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করার জন্য। বিএসইসি চেয়ারম্যান দেশে না থাকায় এ ব্যাপারে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আলোচনার মাধ্যমে জবির সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হবে : মাহফুজ আলম

সাম্য হত্যায় গ্রেপ্তার তামিমের বাড়িতে আগুন দিল জনতা

এখন সবাই পাকিস্তানকে সম্মানের চোখে দেখছে : খাজা আসিফ

শুয়ে মরার থেকে বীর হয়ে শহীদ হওয়া অনেক গর্বের : ইরানের প্রেসিডেন্ট

সেভ দ্য চিলড্রেনে চাকরির সুযোগ

ছাত্রলীগ কর্মীকে ধরে পুলিশে দিল জনতা

রাস্তাতেই রাত কাটিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা 

কেমন কাটতে পারে আজকের দিন, জেনে নিন রাশিফলে

ভারতের ‘আরেকটি অভিযানের’ ভয় করছে পাকিস্তান

দুপুরে যেসব জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড় হতে পারে

১০

‘বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এ বাড়ি থেকে যাব না’

১১

পারস্য উপসাগর / ইরানের চাপে নাম পরিবর্তন থেকে সরছে যুক্তরাষ্ট্র

১২

আজ যেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া

১৩

ইসরায়েলকে ছাড় দিয়ে ইরানকে টার্গেট করছে যুক্তরাষ্ট্র, অভিযোগ আরঘচির

১৪

টিভিতে আজকের খেলা

১৫

১৫ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৭

১৫ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৮

সীমান্তে বজ্রপাতে বিজিবির সদস্যের মৃত্যু

১৯

সীমান্তের ভুল তথ্য দিয়ে হয়রানি, ভুয়া এনএসআই সদস্য আটক

২০
X