দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নির্বাচন, চট্টগ্রাম বন্দরের একটি কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া ও মানবিক করিডোর ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন সেনাপ্রধানও। তার বক্তব্যে অনেকে ইতিবাচক ও অনেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেন, ভোটাধিকার প্রদানে দীর্ঘ বঞ্চনা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করার মাধ্যমে বর্তমান সরকার জনগণ ও দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে, যা তাদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তৈরি হচ্ছে আস্থাহীনতা। সেনাপ্রধানের বক্তব্য কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়; বরং সশস্ত্র বাহিনীরই বক্তব্য, রাজনৈতিক দল ও জনগণের আশার প্রতিফলন। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশার মিল রয়েছে।
গত বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’-এ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলা সভায় সেনাবাহিনী প্রধান রাখাইনে মানবিক করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা, জাতীয় নির্বাচন, চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বেশ কিছু বিষয়ে কথা বলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, দল হিসেবে আমরা অনেক আগে থেকেই ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি করে আসছি। সেটার যৌক্তিকতা হচ্ছে যে, এ সরকার একটি অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার এসেই প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল বা জনগণকে বলেছিল যে, তারা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করবে। জনগণের অধিকারের মধ্যে ভোটের অধিকারটা প্রধান। গত ১৬ বছর ধরে জনগণ এ অধিকার থেকে বঞ্চিত। তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার কখনো অনির্দিষ্টকালের জন্য হয় না। তাই আমরা প্রথম থেকেই অতিদ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দাবি করছি। আরও দল-মত, বুদ্ধিজীবী এবং সেনাবাহিনী প্রধানও মনে করছেন যে, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। অনির্বাচিত একটা সরকার অনেক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলে সেটা প্রশ্নবোধক হয়ে যায়। যেমন এখন করিডোর নিয়ে কথা হচ্ছে। তারপর চট্টগ্রাম বন্দরের কথা শোনা যাচ্ছে, যেখানে বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হবে। সবই অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং জাতীয় স্বার্থ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত। তাই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে আলাপ-আলোচনা করে নিতে হবে এবং জনগণের নির্বাচিত সংসদেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই সেনাপ্রধানের যে বক্তব্য, তিনি অত্যন্ত যৌক্তিক কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স কালবেলাকে বলেন, বন্দর পরিচালনা ইস্যু, রোহিঙ্গাদের জন্য করিডোর এগুলো এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। আমরা মনে করি, শুধু যা জরুরি সরকার তাই করুক। সরকার দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখনো আইনশৃঙ্খলার কোনো উন্নতিই হয়নি, মব দমনে ব্যর্থ সরকার। সংস্কারের নামে কিছু দল সরকারকে উসকানি দিচ্ছে গণভোট করতে, নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে; কিন্তু এগুলো তো এই সরকারের কাজ নয়, যা হওয়ার সংসদে হবে।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, রাজনৈতিক দল ও জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা তা সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। একটা অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন চললে যে সংকট তৈরি হয়, তা বর্তমান বাস্তবতায় লক্ষ্য করছি। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তা পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব দরকার। এই ষোলো বছর ধরে দেশবাসী এজন্য অপেক্ষা করেছে। এ আন্দোলনটাই ছিল ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন করা সম্ভব। সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্যের মাধ্যমে তিন বাহিনীর মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় বন্দর ও করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনির্বাচিত ও অস্থায়ী সরকার নিতে পারে না। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মাধ্যমে গত কিছুদিন ধরে চলা অস্থিরতার অবসান হলো এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও জনগণের যে দূরত্ব ছিল, তা সমাধান হলো। আশা করি অন্তর্বর্তী সরকার এখান থেকে ইতিবাচক বার্তা নেবে, সংস্কার কাজ ছোট করে আনবে। সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে অপ্রয়োজনীয় দূরত্ব কমে আসবে। সরকার ইতিবাচক হিসেবে না নিলে সরকারের সঙ্গে দল ও জনগণের দূরত্ব আরও বাড়বে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত হবে। সরকারকে যেভাবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছি, তা আর সম্ভব নাও হতে পারে। তা ছাড়া সরকারের অন্যভাবে চিন্তা করার সুযোগ নেই, তাত্ত্বিকভাবে তাদের তো রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকার কথা নয়।
আমার বাংলাদেশ পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু বলেন, আমরা যতটুকু জানি সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ ধরনের সরকার; যেখানে সেনাবাহিনী ও সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করছে। অতএব সরকার ও সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। সেনাপ্রধান করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যুসহ যেসব বিষয়ে কথা বলেছেন আপাত দৃষ্টিতে এসব ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পরিলক্ষিত হলেও সরকারের উপদেষ্টা অনেকেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার পক্ষে। সরকারপ্রধানও বলেছেন কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে নির্বাচন। মানবিক করিডোরের বিষয়ে সরকারও এরই মধ্যে বলেছে যে, তারা করিডোর নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি।
আমজনতা দলের যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রহমান কালবেলাকে বলেন, যখন তিনি (সেনাপ্রধান) দেখেছেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে, তখনই তিনি তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। আমরা উনার অবস্থানকে সমর্থন করি, এটার প্রয়োজন ছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের অবচেতন মন বলছে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সালিশের ক্ষমতা দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ বিএনপি ঐতিহাসিকভাবে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ভুক্তভোগী একটা দল। আমরা এখনো এক-এগারোর ইতিহাস ভুলে যাইনি। সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা সতর্ক পাহারাদার। দেশের প্রয়োজনে, সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে, আমরা প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করব। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সুষ্ঠু ক্ষমতা হস্তান্তরের যে আকাঙ্ক্ষা থেকে ২০২৪-এর অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে আমরা মেনে নেব না। রাজনৈতিক সালিশের সুযোগ দিয়ে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের পথ কেউ প্রশস্ত করছে কি না—তা নিয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, আমি মনে করি যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য রক্ষাকবচ। তবে তাদের ভুলে গেলে চলবে না এই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের নিযুক্ত করা হয়েছে। গঠনতন্ত্র, কিছু কাঠামোর মাধ্যমে, কিছু জব রুলসের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কবে নির্বাচন হবে কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তার প্রতি তারা যে মন্তব্য করেছে এ মন্তব্যটি যতই শুনতে ভালো দেখাক না কেন, আমরা মনে করি এমন মন্তব্য থেকে বিরত থাকা উচিত।
মন্তব্য করুন