গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হঠাৎ করেই আলোচনায় আসেন ইউটিউবার এস এ সাব্বির। নিজের নামে ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরকারের নানা সমালোচনাসহ সমসাময়িক বিষয়ে বিভিন্ন ভিডিও প্রচার করতে শুরু করেন। হঠাৎই দুই মাস ধরে ওই চ্যানেলে নতুন ভিডিও আসছিল না। এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ায়, ‘রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ ইউটিউবার সাব্বির।’ শেষ পর্যন্ত পুলিশ নিশ্চিত করে সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় ইউটিউবার এস এ সাব্বিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি কারাগারে।
এ ইউটিউবারের গ্রেপ্তারের তথ্য গণমাধ্যমে আসার পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা চলতে থাকে। দুই মাস ধরে কারাগারে থাকলেও এ তরুণের গ্রেপ্তারের খবর জানতেন না তার এলাকা গাইবান্ধার সাঘাটার লোকজন। তারা এমন খবরে অবাক হয়েছেন। তারা বলছেন, সাব্বির সমসাময়িক নানা বিষয়ে ভিডিও বানিয়ে প্রচার করলেও তিনি কখনো কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। সাব্বিরের বাবা-মা দাবি করেছেন, তাদের ছেলে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে। তারা তার মুক্তিও দাবি করেন।
সাব্বির গ্রেপ্তার হলেও তার ‘এস এ সাব্বির: জনগণের কথা বলে’ নামে ইউটিউব চ্যানেলটি সক্রিয় দেখা গেছে। যদিও দুই মাস আগে সর্বশেষ ভিডিও আপলোড করা হয় সেখানে। চ্যানেলটি ঘেঁটে দেখা গেছে, সাব্বিরের চ্যানেলে ৪০ হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবার। এটি চার বছর আগে চালু করা হয়েছিল। করোনাকালে এক চিকিৎসকের মুভমেন্ট পাস না থাকায় তাকে আটকে দেওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট বিতর্ক নিয়ে ‘সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?’ শিরোনামে ওই ভিডিওটি আপলোড করা হয়। চ্যানেলটিতে মোট ১৭৪টি ভিডিও দেখা গেছে। এর মধ্যে গত ১০ মাসেই অন্তত ১৪০টি ভিডিও পোস্ট করা হয়। এসব ভিডিওতে সমসাময়িক নানা বিষয় ছাড়াও বেশিরভাগই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা করতে দেখা যায়। শুরুর দিকে তার ভিডিওগুলোতে বিগত সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা অসংগতি নিয়েও ভিডিও দেখা যায়। তা ছাড়া শতাধিক শর্ট ভিডিও দেখা যায় ওই চ্যানেলে।
জানা গেছে, এস এ সাব্বিরের পুরো নাম সাব্বির সরকার। তার বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী ইউনিয়নের উত্তর উল্লা বাজার এলাকায়। তার বাবা হেলাল সরকার। পরিবারে দুই বোন ও মা থাকলেও তিনি স্ত্রী বর্ষা আক্তারকে নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তাকে গত ৪ এপ্রিল বনানী থানায় পুলিশের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি মামলায় মুগদার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তিন দিনের রিমান্ডও নেয়।
মামলায় বলা হয়, গ্রেপ্তার হওয়া আসামি (সাব্বির সরকার) অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের সহায়তায় ও পরস্পর যোগসাজশে অনলাইনে তার প্রচার করা বক্তব্য দ্বারা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে দেশের সাধারণ জনগণকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করে আতঙ্ক সৃষ্টিসহ জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছেন। এভাবে আসামি জনগণের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অপরাধ করেছেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, আসামি ইউটিউব বা টিকটক বা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে প্রতিনিয়ত বর্তমান সরকার বিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী ও দেশকে অস্থিতিশীল করাসহ দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্টের লক্ষ্যে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে বিভিন্ন গুজবসহ অসত্য তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে। আসামি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে দেশ ও জনগণের সম্পত্তি ক্ষতি সাধনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার কালবেলাকে বলেন, রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য ও গুজব ছড়ানোর সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সাব্বিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ওসি বলেন, একজন ব্যক্তির জিডির তদন্তের পর সত্যতা নিশ্চিত হয়ে তাকে আটক করা হয়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা দিয়ে ওই আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
অবশ্য সাব্বিরের পরিবারের দাবি, শুধু ইউটিউবে দেশ নিয়ে ‘ভালো-মন্দ’ কথা বলায় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সাব্বির কারাগারে। স্বজন ও স্থানীয় লোকজন তার মুক্তির দাবি করছেন। পাশাপাশি ন্যায়বিচার পেতে সরকারকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সাব্বিরের বাবা হেলাল সরকার স্থানীয় বাজারে লেপ-তোশকের ব্যবসা করেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, তার ছেলে দেশের মানুষের কথা বলত। কথা বলতে কারও পক্ষে-বিপক্ষে গিয়েছে, এজন্য হয়তো ছেলে একটি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘সঠিক কথা বলা কি ছেলের অপরাধ? কেন নিরপরাধ ছেলেটিকে কারাগারে রেখেছে সরকার?’ সাব্বিরের মা শাহিনুর বেগমও ছেলের মুক্তি দাবি করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা হায়দার আলী বলেন, সাব্বির অত্যন্ত ভালো ছেলে বলে তারা জানতেন। তাকে কখনো কোনো দলের রাজনীতি করতে দেখা যায়নি।
সাঘাটা থানার ওসি বাদশাহ আলম বলেন, ইউটিউবার সাব্বিরের বিষয়টি স্থানীয় থানা পুলিশ অবগত রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্র জানায়, ইউটিউবার সাব্বির গাইবান্ধা ফুলছড়ি ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকায় একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে স্টাডিস ফিল্ম ও স্টাডিস মিডিয়া নিয়ে লেখাপড়া করেন। তবে তিনি পরিবারের অমতে সম্পর্ক করে বিয়ে করেন। এতে বছরখানেক বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না তার।
মন্তব্য করুন