মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই একটি বাস্কেটবল গ্রাউন্ড। সেটির পাশ দিয়ে কয়েক পা এগোলেই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবন। দোতলা এই ভবনে পাঠদান চলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। গত সোমবার ভরদুপুরে হঠাৎই যেন আকাশ ভেঙে সেখানেই আছড়ে পড়ে যুদ্ধবিমান। গতকাল মঙ্গলবার একাডেমিক ওই ভবনটির সামনে গিয়ে দেখা গেল, সামনের পুরো অংশ ক্রাইম সিনের ফিতা দিয়ে ঘেরা। উৎসুক জনতা ও স্কুলের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা সেই ফিতা উপেক্ষা করে বহু শিশুপ্রাণ কেড়ে নেওয়া ভবনের কালো ক্ষতগুলো দেখছিলেন উঁকিঝুঁকি দিয়ে।
ক্রাইম সিনের ফিতা ঘেরা জায়গাটি থেকে তখনো জেট ফুয়েলের ঝাঁজালো গন্ধ লাগছিল নাকে, সব ছাপিয়ে মানুষ পোড়া, পাখির মতো ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুদের শরীর পোড়া গন্ধটাও যেন আসছিল ভেসে। স্বজন হারানো মানুষের হাহাকার, আগুনে পুড়ে তারা হয়ে যাওয়া শিশুদের জন্য শোকগাথা মিলিয়ে যাচ্ছিল সেই আকাশে, যেখান থেকে আছড়ে পড়েছিল যুদ্ধবিমান।
সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়ে একক উড্ডয়ন করেছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম। উড্ডয়নের ১৩ মিনিটের মাথায় উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনটিতে। বিধ্বস্ত বিমান থেকে সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলা আগুন ছড়িয়ে পড়ে স্কুল ভবনে, যা থেকে বাদ পড়েনি নিষ্পাপ ছোট্ট শিশুদের শরীরও। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া দগ্ধ ও আহত হন আরও ১৬৪ জন। হতাহতের বেশিরভাগই স্কুলটির ছোট্ট শিক্ষার্থী।
হৃদয়বিদারক এ দুর্ঘটনায় গতকাল দেশজুড়ে পালিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় শোক। আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দগ্ধ শিশুদের চিকিৎসায় সিঙ্গাপুর থেকে আনা হচ্ছে চিকিৎসক।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিধ্বস্ত বিমানটির খণ্ডিত অংশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। তবে দিনভরই মাইলস্টোনের নতুন-পুরোনো শিক্ষার্থীরা দুই উপদেষ্টাকে কলেজ ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখেন। নিহতদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ, আহতদের নির্ভুল তালিকা, শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা, ক্ষতিপূরণ প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধবিমান বাতিল ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ গতকাল অবস্থান নেন দিয়াবাড়িতে। প্রায় অভিন্ন দাবিতে গতকাল সচিবালয়ের সামনে একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
ভয়াবহতার চিহ্ন হায়দার আলী ভবনের সামনে: গতকাল দুপুরের দিকে শিক্ষার্থী আর উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে হায়দার আলী ভবনের সামনে যেতেই চোখে পড়ে এলোমেলো পড়ে থাকা শিশু শিক্ষার্থীদের টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি ও ঢাকনা। তখনো ছড়িয়ে ছিল খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, আধা বোতল পানি। পলিথিনে মোড়ানো খাবারভর্তি আরেকটি টিফিন ক্যারিয়ার রাখা ছিল একটি চেয়ারের ওপর। কার সে খাবার, খেতে পেরেছিল কি না, তা নিয়ে সেখানে চলছিল নানা ব্যথাতুর আলাপ।
পাশেই এক নারী গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে হাত দিয়ে বের করে আনলেন ভেজা একটি খাতা ও বই। খাতার ওপরের পাতায় মার্কার কলমে বাংলায় লেখা, ‘আফসান ওহী।’ তার নিচে লেখা সমাজ, ব্র্যাকেটে ইংরেজিতে লেখা ডব্লিউ-এইচ। বোঝা গেল, এটা ওহীর বাড়ির কাজের খাতা।
অবশ্য সেই খাতার ওপরে পানি ও বালির আস্তরণ নিজের বুকের সঙ্গে মুছে রাজিয়া সুলতানা লিপি নামের ওই নারী অন্যজনকে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখছেন, এটা ওহীর খাতা। ওহীরে খুঁজতে আইসা ওর মা আজ পর্যন্ত নিখোঁজ। আহারে, জায়গার জিনিস জায়গায় পইড়া রইছে আর সন্তান হাসপাতালে, মা নিখোঁজ!’ রাজিয়া জানালেন, তার সন্তানও পড়ে স্কুলটিতে।
গতকাল ঘটনাস্থলে ছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক মো. শাহাদাত হোসেন। তিনি পোড়া স্তূপের কাছ থেকে একটি খাতার ছেঁড়া পাতা হাতে তুলে নিলেন। সেই পাতায় লেখা—মাইলস্টোন প্রিপারেটরি কেজি স্কুলের অধ্যক্ষ বরাবর অনুপস্থিতজনিত ছুটির আবেদনপত্র। আবেদনকারী তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মালিয়া আফরিন। আধভেজা ও ধুলোবালি জড়ানো কাগজটি পরম মমতায় পরিষ্কার করছিলেন ওই শিক্ষক। যেন প্রিয় ছাত্রের স্পর্শ অনুভব করছেন।
সেখানে উপস্থিত অন্য শিক্ষার্থীরা আফসোস করে বলছিলেন, ‘ছুটির দরখাস্ত লিখছে। কে জানে ছুটি চাওয়া ক্লাস থ্রিতে পড়া এই মেয়েটার কপালে কী ঘটেছে!’
গতকাল দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে ডুকরে কেঁদেছেন বহু মানুষ, অনেকে ভেতরের চিত্র খুব বেশিক্ষণ দেখতেও পারছিলেন না।
উৎকট ঝাঁজালো গন্ধে নাক ধরে পিছিয়ে আসা একজন বলছিলেন, ‘গন্ধে নাক পুড়ে যাচ্ছে। আমরা গন্ধই নিতে পারছি না। অথচ এ ভবনেই আগুনে পুড়ে মরেছে বাচ্চাগুলো। আহ…না জানি কত কষ্ট হয়েছে ওদের। যারা বেঁচে আছে আল্লাহ তাদের কষ্ট কমায় দিক।’
এই ব্যক্তি উত্তরার একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তার দিনের অধিকাংশ সময়ই অতিবাহিত হয় কোমলমতি বাচ্চাদের সঙ্গে। তাই গতকাল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসেছিলেন স্কুলের বাচ্চাদের প্রতি অজানা এক টানে। ভেতরের দৃশ্য দেখে বেশ আবেগি হয়ে পড়ায় তার নামটা আর জানা গেল না।
মন্তব্য করুন