২০২০ সালের মার্চে ১৩টি আয়রন ব্রিজ নির্মাণের কাজ অনুমোদন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তবে কাজ বণ্টনে অনিয়ম, নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান, ব্রিজ নির্মাণে অতিরিক্ত ব্যয়সহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বাতিল করা হয় সেই কাজ। কিন্তু এ বছরের জুন মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আয়রন ব্রিজ পুনর্নির্মাণ/পুনর্বাসন প্রকল্পের (আইবিআরপি) অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, এসব ব্রিজের কাজ চলমান। যদিও বাস্তবে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।
জানা গেছে, কাজ বাতিল ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধান প্রকৌশলীর দেওয়া নির্দেশনা নথি থেকে সুকৌশলে মুছে ফেলা হয়েছে। এরপর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠানো হয়েছে ব্রিজ নির্মাণের ফাইল। ফলে এলজিইডির দপ্তরের কাগজপত্রে ১৩টি ব্রিজের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও অন্য সব জায়গার নথিতে রয়ে গেছে এগুলোর নির্মাণ কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিকাদারদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী সৈয়দ আহমদ আলী নিজেই এই চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আয়রন ব্রিজ পুনর্নির্মাণ/পুনর্বাসন প্রকল্প (আইবিআরপি) প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী সদর উপজেলায় ১৩টি ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সেই আলোকে ২০২০ সালের মার্চে অনুমোদন করা হয় প্রকল্প।
প্রকল্পের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, তখন ব্রিজের ডিজাইন, ড্রয়িং ও প্রাক্কলন প্রণয়ন করেছিল এলজিইডির ডিজাইন ইউনিট। এর ভিত্তিতেই প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। তবে এর প্রায় পাঁচ মাস পর নতুন করে ব্রিজের প্ল্যান এবং ডিজাইন যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নথিপত্র বলছে, প্রকল্পটি যখন অনুমোদন হয়, তখন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই। নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন সৈয়দ আহমদ আলী। তবে কিছু দিন পরই প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পান তিনি। এর পরই অনুমোদন হওয়া প্রকল্পে নতুন করে সেটিং লে আউট প্ল্যানের প্রায়োগিক বাস্তবতা সম্পর্কে মতামত আহ্বান করেন সৈয়দ আহমদ আলী। ঠিকাদারদের অতিরিক্ত সুবিধা দিতেই প্রকল্পের অনুমোদন হওয়া কাজের ডিজাইনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয় বলে এলজিইডি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।
জানা যায়, পটুয়াখালীতে ১৩টি ব্রিজ নির্মাণের কাজ পান মাত্র দুজন ঠিকাদার। দুজনই প্রকল্প পরিচালকের ঘনিষ্ঠ। প্রকল্পের কাজ বণ্টনে নানা অনিয়মের অভিযোগও উত্থাপিত হয়। প্রয়োজন নেই—এমন স্থানে ১৩টি ব্রিজ নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান, নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান, ব্রিজ নির্মাণে অতিরিক্ত ব্যয় প্রদর্শনসহ নানা অভিযোগ ওঠে এই কাজ বণ্টনে।
জানা যায়, সৈয়দ আহমদ আলী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আয়রন ব্রিজ প্রকল্পের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এ নিয়ে দুদকেও অভিযোগ জমা হয়েছে। দুদকে বিষয়টি আমলে নিয়ে ইতোমধ্যে তদন্তও করছে। এর আগেও আইবিআরপি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল পটুয়াখালীতে। জেলার সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামীণ সড়কের আইডি নম্বরে ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে শহরে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে খালের অস্তিত্ব না থাকলেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ব্রিজ বানানোর। এ ছাড়া কয়েকটি স্থানে রাস্তা না থাকলেও সেখানে ব্রিজ বানানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল।
এমন নানা অনিয়মের কারণে ২১টি ব্রিজের কাজ কোনো অবস্থাতেই শুরু করা যাবে না বলে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল হাই প্রাক্কলন স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। তবে প্রকল্প পরিচালক বদল হওয়ার পর আবার সব বদলে যায়। ব্রিজের প্রয়োজন নেই, এসব স্থানে ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে ৪টি নোটিশে ৩২টি ব্রিজের কার্যাদেশ দেওয়া হয় তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে। সেই কাজে দুর্নীতি এবং অনিয়ম নিয়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর হোসেন হাওলাদারকে আহ্বায়ক করে গঠিত এ তদন্ত কমিটি অনিয়মের প্রমাণও পেয়েছিল।
এ বিষয়ে মো. নূর হোসেন হাওলাদার গতকাল সোমবার কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা ওই সময়েই তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম। যেটা দেখেছি, সে অনুযায়ী রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে।’
তবে সূত্র বলছে, তদন্ত কমিটিতে শহর ও গ্রামের আইডি আলাদাভাবে কাজ করার নির্দেশনা দিলেও এখন পর্যন্ত আগের মতোই কাজ চলছে। বেশ কয়েকটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে অপ্রয়োজনীয় স্থানে।
জানা যায়, নতুন করে নেওয়া ১৩টি ব্রিজ নির্মাণের কাজ গত ১ জুন বাতিল ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে পত্রে উল্লেখ করা হয়, এর আগে এসব প্যাকেজের বিপরীতে যে ব্যয় প্রাক্কলন অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, তাও বাতিল করা হয়েছে।
নথিতে দেখা যায়, ৪৪৭১৮৬, ৪৪৭১৯৮, ৪৪৭১৯০, ৪৪৭১৯৬ ও ৪৪৭১৯৭ নম্বর আইডির টেন্ডারের কাজের ক্ষেত্রে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মতামত দেন বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রস্তাবিত স্থানে ব্রিজ নির্মাণের বাস্তব উপযোগিতা না থাকায় এবং আর্থিক অপ্রতুলতার কারণে নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের পাওনা পরিশোধ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় কাজ বাতিল করা হয়েছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, ব্রিজ নির্মাণের উপযোগিতা না থাকার পরও এই স্থানে ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল।
৪৪৭১৮০৮ এবং ৪৪৭১৮৯ নম্বর আইডির কাজ বাতিলের ক্ষেত্রেও কারণ হিসেবে বলা হয়, সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড কালভার্ট নির্মাণ করায় ব্রিজের প্রয়োজন নেই। একইভাবে ৪৪৭১৮৮, ৪৪৭১৮৯, ৪৪৭১৮৭ এবং ৪৪৭১৯২ নম্বর আইডির কাজ বাতিলের কারণ হিসেবেও বলা হয়, বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রস্তাবিত স্থানে ব্রিজ নির্মাণের উপযোগিতা না থাকায় এবং আর্থিক অপ্রতুলতায় নির্ধারিত সময়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের পাওনা পরিশোধ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
তবে এলজিইডি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইবিআরপি প্রকল্পে যেসব জেলায় কাজ চলছে, বেশিরভাগ কাজেই নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। যেসব স্থানে ব্রিজের প্রয়োজন নেই, রাস্তা নেই কিংবা জনমানবের চলাচল কম, সেসব স্থানে ব্রিজ করার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এতদিন প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নেওয়ার পর উপযোগিতা নেই বলে ১৩টি ব্রিজ নির্মাণকাজ স্থগিত করা হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগেই এসব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
কাজ বাতিলের এ নথিতে স্বাক্ষর করেছেন প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী সঞ্জয় কুমার হালদার, প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ আহমদ আলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর হোসেন হাওলাদার এবং এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ মহসিন। প্রধান প্রকৌশলী স্বাক্ষরের পাশাপাশি লিখিত নোটে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও লেখেন। তবে পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, ভিন্ন নথিতে প্রধান প্রকৌশলীর স্বাক্ষর থাকলেও তার নোটের অংশটুকু নেই।
এ নিয়ে এলজিইডি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান প্রকৌশলীর নোট মুছে ফাইলটি পাঠানো হয়েছে। এটি বড় ধরনের জালিয়াতি। নথিতে দেখা যায়, চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, সেখানেও এই কাজগুলো চলমান বলে দেখানো হয়েছে। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কাজ আনুষ্ঠানিক বাতিল ঘোষণার পরও কীভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব কাজকে চলমান হিসেবে দেখানো হয়।
এসব বিষয়ে জানতে আইবিআরপি প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী সৈয়দ আহমদ আলীকে ফোন করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর ব্যস্ত আছেন জানিয়ে ফোন রেখে দেন।
মন্তব্য করুন