আমজাদ হোসেন হৃদয়
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডাকসুর ফল বিশ্লেষণ

বিভক্তিতে ভরাডুবি বাগছাসের

বিভক্তিতে ভরাডুবি বাগছাসের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস)। ডাকসুর ২৮টি পদের কোনোটিতেই বাগছাস সমর্থিত প্যানেল ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি। গত মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ হওয়া এই নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে তাদের প্রার্থীরা ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীদের মধ্যে ভোট পাওয়ার হিসাবে তালিকার পাঁচ নম্বরে। এমন হতাশাজনক ফলে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠা বাগছাস নেতাকর্মীদের মধ্যে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না হওয়াই সংগঠনটির এ ভরাডুবির মূল কারণ।

ডাকসুর এবারের নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম, দ্বিতীয় হয়েছেন ছাত্রদল প্যানেলের আবিদুল ইসলাম খান। তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। আর বাগছাস সমর্থিত প্যানেলের আব্দুল কাদের ১ হাজার ১০৩ ভোট পেয়ে হয়েছেন পঞ্চম। আর শিবির প্যানেলের এস এম ফরহাদ ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে জিএস নির্বাচিত হন। একই পদের লড়াইয়ে বাগছাস প্যানেলের আবু বাকের মজুমদার ২ হাজার ১৩১ ভোট পেয়ে হয়েছেন পঞ্চম।

সংগঠনটির নেতাকর্মীরা এমন লজ্জাজনক হারের কোনো মূল্যায়ন করতে পারছেন না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতাদের এমন ভরাডুবি অনেকেই মানতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন, হারলেও সম্মানজনক স্থানে থাকবেন বলেই তাদের বিশ্বাস ছিল। বিশেষ করে ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদেরের মাত্র ১ হাজারের কিছু বেশি ভোট পাওয়া তাদের কাছে অবিশ্বাস্য। তবে নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বিভাজনও স্বীকার করছেন তারা।

বাগছাস নেতারা বলছেন, সংগঠনের মধ্যে শৃঙ্খলা নেই বললেই চলে। নেতারাও নিজের মতো করেই চলেন। নির্বাচনের আগেই কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন। নেতাদের মধ্যে বিভাজন দৃশ্যমান হয়ে পড়েছিল। এটা শিক্ষার্থীরা পছন্দ করেননি। এ ছাড়া অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট টানতে না পারাকেও পরাজয়ের বড় কারণ মনে করছেন তারা।

ডাকসুর এজিএস পদেই সংগঠনের পাঁচ নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্যানেল থেকে প্রার্থী ছিলেন আশরেফা খাতুন। তিনি পেয়েছেন মাত্র ৯০০ ভোট। একই পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতা তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী ৩ হাজার ৮, হাসিবুল ইসলাম ৫০০, আশিকুর রহমান জীম ৭৯৬ ও সানজানা আফিফা ৩৭৩ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন। এ পদ নিয়েই বেশি হয়েছে জলঘোলা, যা শিক্ষার্থীদের মাঝে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে। এ ছাড়া সম্পাদকীয় কয়েকটি পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতারা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হন। কেউ কেউ নির্বাচনের আগে সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে অন্য প্যানেলে ডাকসুতে ও হল সংসদের বিভিন্ন পদে প্রার্থী হন।

সংগঠনের এমন হতাশাজনক ফলের কারণ কী—জানতে চাইলে বাগছাসের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব জাহিদ আহসান কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই তাদের অবদান অনুযায়ী শীর্ষ পদগুলোতে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। যার ফলে শুধু এজিএস পদেই আমাদের পাঁচজন ছিল। অন্য কয়েকটি পদেও এমন চিত্র দেখা গেছে। যার ফলে আমাদের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। এটা অন্যতম কারণ। এ ছাড়া আমরা সংগঠন হিসেবে খুবই নবীন। অন্যদিকে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির অনেক পুরোনো সংগঠন। আমরা প্রস্তুতির জন্য খুব বেশি সময়ও পাইনি।’

অন্যদিকে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার মনে করেন, পরিচয় লুকিয়ে অনেকেই তাদের সংগঠনে প্রবেশ করায় সংগঠন শক্তিশালী হয়নি এবং বিভাজন দেখা দিয়েছে। সংগঠিতভাবে কাজ করতে না পারাকে বড় ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ডাকসু নির্বাচনে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছিল বাগছাসের প্যানেলকে। দলটির ফেসবুক পেজে তাদের পক্ষে চাওয়া হয়েছে ভোট। খোদ এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও ফেসবুক স্ট্যাটাসে আব্দুল কাদের এবং আবু বাকের মজুমদারের জন্য ভোট চেয়েছেন। এ ছাড়া মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমসহ অন্য নেতারাও তাদের হয়ে ভোট চান। লেজুড়বৃত্তিক না দাবি করা বাগছাসের জন্য এটাও কিছুটা নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন অনেকেই।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘বাগছাস এখনো সাংগঠনিক ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচনে এর প্রভাব দেখা গেছে। তবে এবারের ডাকসুই তাদের শেষ গন্তব্য নয়। আদর্শিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত হলে ভবিষ্যতে তারা ভালো করবে।’

ডাকসু ও ছেলেদের হলগুলোতে ভরাডুবি হলেও ছাত্রীদের পাঁচটি হলে এগিয়ে ছিলেন বাগছাস সমর্থিত প্রার্থীরা। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল, সুফিয়া কামাল হল ও শামসুন নাহার হলে শীর্ষ দুই পদে নির্বাচিত হয়েছেন বাগছাস সমর্থিত প্রার্থীরা। এর মধ্যে কুয়েত মৈত্রী হলের ভিপি হয়েছেন রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, জিএস নিশিতা জামান নিহা, শামসুন নাহার হলের ভিপি কুররাতুল আইন কানিজ, জিএস হয়েছেন সামিয়া মাসুদ মম এবং সুফিয়া কামাল হলে জিএস নির্বাচিত হয়েছেন শিমু আক্তার। অন্য দুই হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।

বাগছাস সদস্য সচিব জাহিদ আহসান বলেন, ‘আমরা ডাকসুতে কোনো পদে জিততে না পারলেও হল সংসদে তুলনামূলক ভালো করেছি। বিশেষ করে মেয়েদের হলে আমরা শীর্ষ বেশ কয়েকটা পদ পেয়েছি। ডাকসুতে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল না পেলেও আমরা মনে করি, যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তারা অনেক বেশি ক্যাপাবল (সামর্থ্যবান)। তারা আগামীর ছাত্র রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। সংগঠন হিসেবে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদও আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।’

প্রাক নির্বাচনী জরিপ ফলাফলের প্রতিফলন: ডাকসু নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে নির্বাচনের আগের কয়েকদিনে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপের ফলের প্রতিফলন দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের পরিচালিত জরিপের অধিকাংশ জরিপেই ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা বিপুল জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে ছিলেন। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলেও সেই জনসমর্থনের প্রমাণ মিলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে জরিপের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন বিজয়ী প্রার্থীরা।

প্রাক নির্বাচনী কয়েকটি জরিপের মধ্যে প্রথম জরিপটি পরিচালনা করে ‘সোচ্চার’ নামে একটি সংগঠন। ৯৯১ জন শিক্ষার্থী এ জরিপে অংশ নেন। এ প্ল্যাটফর্মের জরিপে ভিপি পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থী এগিয়ে থাকবেন বলে জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৩২ শতাংশ মতামত দেন। ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী জয়ী হবেন বলেছেন ৭ শতাংশ ভোটার। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে ছিলেন ২২ শতাংশ। আর ৩৪ শতাংশ ভোটার এ বিষয়ে কোনো মত জানাতে রাজি হননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ পরিচালিত জরিপে অংশ নেন ৯০০ শিক্ষার্থী। এতে ২০.৯২ শতাংশ উত্তরদাতা ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটে এবং ১৬.৪২ শতাংশ উত্তরদাতা ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন বলে আভাস দেন। আর অন্যান্য প্যানেলে ভোটের হার দেখানো হয় গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সমর্থিত প্যানেলে ৪.৭৬ শতাংশ, সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলে ১.৬০ শতাংশ এবং ৭ বাম ছাত্র সংগঠন সমর্থিত প্যানেলে ২.১০ শতাংশ।

‘ন্যারেটিভ’ নামে অন্য একটি প্ল্যাটফর্মের জরিপে, ভিপি পদে আবু সাদিক কায়েমের পক্ষে মতামত দেন ৪১.৯ শতাংশ ভোটার, শামীম হোসেনের পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন ১৬.৫ শতাংশ, আবিদুল ইসলামের পক্ষে ১৩.৯ শতাংশ এবং উমামা ফাতেমার পক্ষে মতামত দেন ৮.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিএস পদে এসএম ফরহাদের পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন ৩২.১ শতাংশ ভোটার, আরাফাত চৌধুরীর পক্ষে ১৬.১ শতাংশ, মেঘমল্লার বসুর পক্ষে ৯.১২ শতাংশ, তানভীর বারী হামীমের পক্ষে ১৬.১ শতাংশ এবং আবু বকর মজুমদারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন ১৩.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। এজিএস পদে মহিউদ্দিন খানের পক্ষে মতামত দেন ৫২.৯ শতাংশ, তানভীর আল হাদী মায়েদের পক্ষে ১৫.৯ শতাংশ, আশরেফা খাতুনের পক্ষে ৯.৪৯ এবং জাবির আহমেদ জুবেলের পক্ষে মতামত দেন ৪.০৭ শতাংশ শিক্ষার্থী।

জরিপগুলোর ফলাফলে বাস্তবতার প্রমাণ মিলেছে। জরিপে উঠে আসা ভোটের চেয়ে আরও বেশি সমর্থন পেয়ে যথাক্রমে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন আবু সাদিক কায়েম, এসএম ফরহাদসহ শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর হওয়া ডাকসুর এবারের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ২৮টি পদের ২৩টিতেই বিপুল ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের প্রার্থীরা। ভিপি পদে এ প্যানেলের আবু সাদিক কায়েম ব্যালট বাক্সে পড়া মোট ভোটের ৪৭ শতাংশ, জিএস পদে এসএম ফরহাদ ৩৬ শতাংশ এবং এজিএস পদে মহিউদ্দিন খান ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাকসুর ভোট গণনা শেষ

কেরানীগঞ্জে দিনদুপুরে যুবক খুন

সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, মাছ কিনতে বিপাকে ক্রেতারা

বিশ্লেষণ / সামরিক শক্তিতে কতটা এগিয়ে কাতার

অভিজ্ঞতা ছাড়াই আবেদন করুন আবুল খায়ের গ্রুপে

পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে কি না বুঝবেন কীভাবে, জানালেন চিকিৎসক

ছোট ভাইয়ের বঁটির কোপে বড় ভাই খুন 

দারাজের এইচআর বিভাগে ইন্টার্ন করার সুযোগ, আজই ‍আবেদন করুন

সুনামগঞ্জে কার-মোটরসাইকেল সংঘর্ষে নিহত ২

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে চাকরির জন্য আবেদন করুন

১০

‘জাকসুতে ভোট কারচুপির প্রমাণ দিতে পারলে চাকরি ছেড়ে দেব’

১১

মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সাড়ে ৪ কোটি টাকার প্রকল্প

১২

বৃষ্টি বাড়বে না কমবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৩

রেকর্ডের দ্বারপ্রান্তে তাসকিন-লিটন

১৪

নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী কে এই সুশীলা কার্কি

১৫

ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কবে দায়িত্ব নেবেন, জানা গেল

১৬

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে একাদশ নিয়ে মাঠে নামতে পারে বাংলাদেশ

১৭

সাবেক ডিআইজি নাহিদুল ইসলাম গ্রেপ্তার

১৮

চুনারুঘাট থানার ওসি ক্লোজড

১৯

মায়ের সঙ্গে শপিংয়ে যান না অভিষেক বচ্চন

২০
X