

গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পূর্ব থানার টিঅ্যান্ডটি বাজার জামে মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ মিয়াজী এক সময় নিজেকে অপহৃত দাবি করেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার নিখোঁজ ও উদ্ধার নিয়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে পুলিশি তদন্তে উন্মোচিত হতে থাকে একেক করে লুকিয়ে থাকা তথ্য। শেষ পর্যন্ত সব প্রমাণ ও স্বীকারোক্তি মিলিয়ে এখন স্পষ্ট—এটি ছিল একটি সাজানো অপহরণ নাটক, যার মূল নায়ক ছিলেন খতিব নিজেই।
এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে মহানগর পুলিশ। সংবাদ সম্মেলনে জিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান জানান, ইমাম মহিবুল্লাহ অপহরণের পেছনে ইসকন জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছিল। তবে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে—তিনি নিজে শ্যামলী পরিবহনের বাসের টিকিট কেটে পঞ্চগড় গিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইমাম মহিবুল্লাহর বাসের সহযাত্রী এবং বাসের সুপারভাইজারও পুলিশের হেফাজতে আছেন। এরই মধ্যে ইমাম মহিবুল্লাহ পুলিশের কাছে প্রকৃত ঘটনা স্বীকার করেছেন।
মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান বলেন, মহিবুল্লাহ অপহরণের যে বর্ণনা দিয়েছেন এবং যে সময় ও স্থান থেকে তাকে তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন, সেই সময়ের ওইসব এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ অপহরণের কোনো প্রমাণ পায়নি। তিনি নিজেই নিজের পায়ে শিকল লাগিয়ে শুয়ে ছিলেন। তাকে উদ্ধারের পর মামলায় যা বলেছেন, তার পুরোটাই সাজানো গল্প।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের শেষ পর্যায়ে যাচ্ছি। প্রমাণ অনুযায়ী মামলার সুপারিশ ও প্রতিবেদন আদালতে পাঠানো হবে। প্রয়োজনে মানসিক স্থিতি যাচাইয়ের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মতামতও নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মুফতি মহিবুল্লাহকে অপহরণ করা হয়েছিল—এমন অভিযোগে তিনি ২৪ অক্টোবর টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ২২ অক্টোবর সকালে হাঁটতে বের হলে একটি অ্যাম্বুলেন্স তার পথ রোধ করে। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয়। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরে পঞ্চগড়ের স্থানীয় লোকজন জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ কল করলে সদর থানার পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি টঙ্গী পূর্ব থানার পুলিশের সহায়তায় পঞ্চগড় থেকে গাজীপুরে নিজের বাসায় ফেরেন।
এ বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মামলার তদন্তকারী দল বাদীর বাসা থেকে ঘটনাস্থল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেয়। তদন্তকালে দেখা যায়, এজাহারে চার থেকে পাঁচজন বাদীকে জোর করে অ্যাম্বুলেন্স তোলার কথা বলা হলেও তিন ঘণ্টার মধ্যে যেখানে কোনো অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের দৃশ্য সিসি ক্যামেরায় দেখা যায়নি। আর যেসব স্থানের কথা বাদী উল্লেখ করেছেন, সেগুলোও যাচাই-বাছাই করা হয়।
যাচাই করে দেখা যায়, ২২ অক্টোবর রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে মহিবুল্লাহ পঞ্চগড়ের সর্বশেষ বাসস্টেশনে নেমে হাঁটতে থাকেন। ফুটেজে তাকে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও জেলা পুলিশ লাইন্সের আশপাশে দেখা যায়। সেখান থেকে তিনি কিছুদূর এগিয়ে অন্ধকার একটি জায়গায় যান। রাস্তার পাশে প্রস্রাব করতে যান। অসুস্থতার কারণে তার পায়জামা ও পাঞ্জাবি ভিজে যায়। তিনি নিজের হাতে কাপড় খুলে ফেলেন। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি ছোট তালাযুক্ত শিকল পায়ে জড়িয়ে তিনি রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে জেগে তিনি দেখতে পান, পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে আছেন। অনেকে তখন তার সঙ্গে কথা বললে তিনি অবচেতন মনে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ দাবি করে।
ঘটনার সূচনা: ২১ অক্টোবর বিকেল ৪টা। নামাজ শেষে খতিব মহিবুল্লাহ বেরিয়ে পড়েন মসজিদ থেকে, তারপর আর দেখা যায়নি তাকে। পরদিন সকালে তার পরিবার টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যেখানে উল্লেখ করা হয়—তিনি নামাজ পড়তে গিয়ে অপহৃত হয়েছেন।
এ সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায়। মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে উদ্বেগ, স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা, আর অনলাইনে নানা জল্পনা—সব মিলিয়ে ঘটনাটি তখন আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়। পুলিশও বিষয়টিকে প্রথমে গুরুত্ব দিয়েই নেয়। বিশেষ টিম মাঠে নামে, এলাকায় চালানো হয় সিসিটিভি তল্লাশি। প্রথম তিন দিনের তদন্তেই পুলিশ পায় বড় ধরনের মোড় ঘোরা তথ্য। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, অপহরণের কোনো দৃশ্য নেই। বরং ২১ অক্টোবর বিকেলেই মহিবুল্লাহকে দেখা যায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠতে। তিনি একা, তার চারপাশে কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা জোরপূর্বক তৎপরতা নেই।
সিসিটিভি ফুটেজে আরও যা পাওয়া গেল: ফুটেজ বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, মহিবুল্লাহ কিছুক্ষণ পর মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন, তারপর ধীরে ধীরে এলাকা ত্যাগ করেন। মোবাইল ফোনের টাওয়ার ট্র্যাকিং রিপোর্টেও নিশ্চিত হয়—তিনি একটানা গাজীপুর থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে পঞ্চগড় পর্যন্ত গেছেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি কেউ অপহৃত হয়, তার মোবাইল সাধারণত বন্ধ থাকে বা অপরিচিত এলাকায় ট্র্যাক পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে দেখা গেছে, তার ফোনে কল আদান-প্রদান হয়েছে। এটা সন্দেহের বড় কারণ।’
শিকল বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার: ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থানার হেলিপ্যাড বাজার এলাকায় স্থানীয়রা একজন ব্যক্তিকে একটি গাছের সঙ্গে শিকল বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান। ঘটনাটি দ্রুত স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। উদ্ধারের সময় তিনি বলেন, ‘আমাকে অপহরণ করে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে।’ পুলিশ প্রথমে ঘটনাটি অপহরণ হিসেবেই ধরে নেয়। তবে কয়েক ঘণ্টা পরই সন্দেহ জাগে। কারণ, তার হাত-পা বাঁধা থাকলেও, বাঁধনের দড়ি ছিল ঢিলা এবং শরীরে আঘাতের কোনো দাগ দেখা যায়নি। তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান, তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। শুধু ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এই রিপোর্ট পুলিশের হাতে আসতেই তদন্তের চিত্র পাল্টে যায়। ২৪ অক্টোবর দুপুরে জিএমপির তদন্ত দল পঞ্চগড়ে পৌঁছে মহিবুল্লাহকে হেফাজতে নেয়।
পুলিশ হেফাজতে পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ: সোমবার রাতে মুফতি মহিবুল্লাহকে টঙ্গী পূর্ব থানার ওসির নেতৃত্বে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি স্বীকার করেন, তিনি অপহৃত হননি। নিজের ইচ্ছায় আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগত মানসিক চাপে আমি কয়েকদিনের জন্য দূরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঘটনাটি এমন দিকে গড়ায়, যেখান থেকে ফেরাটা কঠিন হয়ে পড়ে।’
এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিকভাবে তিনি স্বীকারোক্তি দিলেও পরে বিষয়টি লিখিতভাবে রেকর্ড করার জন্য আদালতের নির্দেশ নেওয়া হয়। গতকাল দুপুরে মহিবুল্লাহকে গাজীপুর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী তার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
আদালতকে যা বললেন মহিবুল্লাহ: বিচারকের সামনে দেওয়া জবানবন্দিতে মহিবুল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমি অপহৃত হইনি। নিজের পরিকল্পনায় আত্মগোপনে গিয়েছিলাম। পরে নিজেই শিকল বেঁধেছিলাম, যেন অপহরণের গল্পটি সত্য মনে হয়।’
ঘটনার পর মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ মিয়াজী একটি ভিডিও বার্তায় ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, অনেক সময় তার মাথায় এমন সমস্যা দেখা দেয়। এর আগেও এমনটা হয়েছিল।
গতকাল আদালত তার বক্তব্য রেকর্ড করে পুলিশকে পরবর্তী পদক্ষেপের নির্দেশ দেন। জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর আদালতের নির্দেশে তাকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়। আদালতের কাজ শেষে খতিব মহিবুল্লাহকে পুনরায় টঙ্গী পূর্ব থানায় নেওয়া হয়। সেখানে তার আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদের শেষ ধাপ সম্পন্ন হয়। পরে বিকেলে পুলিশ প্রটোকলে তাকে নিজ বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
টঙ্গী পূর্ব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মেহেদী হাসান বলেন, ‘মুফতি মহিবুল্লাহকে আমরা পরিবারের জিম্মায় দিয়েছি। মানসিকভাবে যেন তিনি স্থিতিশীল থাকতে পারেন, সে বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তার গতিবিধি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। তার অপহরণ নাটকের পেছনে আরও কেউ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
হতাশ-বিস্মিত স্থানীয়রা: টিঅ্যান্ডটি বাজার জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি হাফেজ জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রথমে ঘটনাটি বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এখন পুলিশ যেভাবে তথ্য দিয়েছে, সেটাই সত্য মনে হচ্ছে। মুসল্লিদের কেউ কেউ হতাশ, কেউবা বিস্মিত। স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, ‘খতিব সাহেব খুব চুপচাপ মানুষ ছিলেন। হঠাৎ করে এমন কাণ্ড করবেন, তা ভাবতেও পারিনি।’
মন্তব্য করুন