

বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেল। মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর পরই দলগুলোর মধ্যে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশায় যখন পুরো জাতি উন্মুখ, তখনই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ-পদ্ধতি নিয়ে এই বিতর্ক ও মতপার্থক্য দলগুলোর ঐক্যের পথে কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে অংশ নেওয়া ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সনদ বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ দেশের স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একদিকে যেমন সরকার দ্রুত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে চাইছে, অন্যদিকে সনদ বাস্তবায়নের শর্ত, গণভোটের সময়সীমা এবং সংস্কারের পদ্ধতি নিয়ে প্রধান দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করছে। সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে অসংগতি আছে জানিয়ে বিএনপি বলছে, ঐকমত্য কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে শুধু জাতি বিভক্ত হবে, কোনো ঐকমত্য হবে না। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই সনদের সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখছে।
সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থায় সংস্কারের সুপারিশ দেওয়ার জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এ ছয় কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। ৩৩টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশসহ ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হয়। গত ১৭ অক্টোবর সংসদ ভবন চত্বরে জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হয়। এরই মধ্যে ২৫টি দল ও জোট জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। তবে সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতভেদ থেকেই যায়। এরপরও দীর্ঘ আলোচনা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের একটি খসড়া অন্তর্বর্তী সরকারকে মঙ্গলবার জমা দেয়। ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করতে সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে সরকারকে তিনটি ভাগে সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন।
ঐকমত্য কমিশন প্রতারণা করেছে—বিএনপি: ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার পর নতুনভাবে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেদিনই আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে দেখা করে প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নেতৃত্বদানকারী সালাহউদ্দিন আহমদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে, সেই স্বাক্ষরিত সনদবহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে। হয়তো বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমস্যাটা নিয়ে আবার আলোচনা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এখানে একটা নতুন বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদের নামে একটা আইডিয়া সংযুক্ত করা হয়েছে। যেটা আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কখনো টেবিলে ছিল না, আলোচিত হয়নি। এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি।
গতকালও এক অনুষ্ঠানে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। এখন এখানে (সুপারিশে) এসে এই অবস্থায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে শুধু জাতিতে বিভক্তি হবে, অনৈক্য হবে এবং এখানে কোনো ঐকমত্য হবে না। এর ভিত্তিতে তারা কী অর্জন করতে চায় আমরা জানি না। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় দেখতে চাই। তারা যেন নিরপেক্ষভাবে আচরণ করে এবং তাদের সব কর্মকাণ্ডে যেন জাতি একটা আশ্বস্ত হতে পারে, ঐক্য থাকতে পারে, সেভাবেই যেতে হবে। আমরা ঐকমত্য কমিশনের এবং সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে হতাশা ব্যক্ত করছি।
অন্যদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গতকাল পৃথক অনুষ্ঠানে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি, আমরা যে বিষয়গুলোর সঙ্গে একমত ছিলাম না; আমরা সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলাম, সেই নোট অব ডিসেন্টগুলো লিপিবদ্ধ করার একটা প্রতিশ্রুতি ছিল তাদের (কমিশন)। কিন্তু সেই নোট অব ডিসেন্টগুলো নেই, পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা তো ঐকমত্য হতে পারে না। তাহলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনটা করা হয়েছিল কেন? এই ঐকমত্য কমিশন আমি বলব জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা। এগুলো অবিলম্বে সংশোধন করা প্রয়োজন।
নভেম্বরেই গণভোট চায় জামায়াত: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশকে ‘ইতিবাচকভাবে’ দেখছে। এখন এর বাস্তবায়নে অবিলম্বে আদেশ জারি এবং আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করা দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের কালবেলাকে বলেন, আমরা কমিশনের সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। অবিলম্বে সনদ বাস্তবায়নের আদেশ দেওয়ার দাবি করছি। সেইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের মাধ্যমে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি করছি।
এদিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানে গণভোট কখন হবে, সেটি স্পষ্ট করে বলেনি। এর মাধ্যমে গণভোটের তারিখ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ‘বল’ এখন চলে গেছে সরকারের কোর্টে। এ বিষয়ে এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন যদি সুনির্দিষ্ট করে জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করত, তাহলে ঝামেলা সৃষ্টি হতো না। এখন সরকারের দায়িত্ব দ্রুত গণভোটের তারিখ ঘোষণা করা; জাতিকে সংকটমুক্ত করা। রাজনীতির আকাশে যেই মেঘ জমেছে, সেটাকে দূর করে আলোর দিশা দেওয়ার দায়িত্ব এখন প্রধান উপদেষ্টার।
ইতিবাচকভাবেই দেখছে এনসিপি: জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জমা দেওয়া সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। ঐকমত্য কমিশনের সভায় প্রতিনিধিত্ব করা এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, গণভোটের ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) কার্যকারিতা না রাখা, পুরো সনদকে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ফরম্যাটে গণভোটে দেওয়া এবং গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তিতে আদেশ জারি করা—এ বিষয়গুলোকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। ২৭০ দিনের জন্য সংবিধান সংস্কার পরিষদ রাখার বিষয়টিও ইতিবাচক। তবে আমরা সংস্কারকৃত সংবিধানকে সংশোধিত সংবিধান, ২০২৬ নামকরণের কথা বলেছিলাম।
ঐকমত্য কমিশনের জমা দেওয়া সুপারিশে বিএনপির অসন্তুষ্টি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে বিষয়গুলো বিএনপির বিপক্ষে যায়, তারা সেগুলোকে অনৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে দেখে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে অধিকাংশ দল যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, বিএনপি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির ক্ষেত্রে ২৫টি দল একমত, বিএনপি আর এনডিএম একমত হয়নি। মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে ৩০টি দলের মধ্যে ২৫ থেকে ২৮টি দল একমত হয়েছে, সেখানে বিএনপি ও তাদের সমমনা কয়েকটি দল দ্বিমত করেছে। তিনি বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
বিশেষজ্ঞ মত: এ নিয়ে গতকাল কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে স্বাক্ষরের পর এটা (সনদ) চেঞ্জ করলেন কেন? স্বাক্ষরের দিনই চেঞ্জসহ স্বাক্ষর করলেন না কেন?
যদি পরিবর্তনই হবে তাহলে স্বাক্ষরের দিনই উপস্থাপন করতে পারত জানিয়ে মাহবুবুর রহমান বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ঐকমত্য কমিশন কি এটা ঠিক করল? স্বাক্ষরের পর কি চেঞ্জ করা যায়? তিনি বলেন, আমরাও তো দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছু স্বাক্ষর করি। স্বাক্ষরের পর আরেকটা কিছু লিখে দিলাম, তখন কি সেটার কার্যকারিতা থাকে?
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও বলেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মতো এত বড় একটা প্রেস্টিজিয়াস প্রোগ্রাম ইতিহাসের অংশ হওয়ার কথা। যারা স্বাক্ষর করেছে, পরবর্তী সময়ে তাদের সঙ্গে আলাপ না করে ঐকমত্য কমিশন যদি চেঞ্জ করে থাকে, এটা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। সেই প্রশ্নটাই রাজনীতি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্নার থেকে এসেছে। যে কারণে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল দাবি করছে, এই পরিবর্তনটার ব্যাপারে যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার আছে। এটা ঐকমত্য কমিশনের দায়। এটা ব্যাখ্যা দিতে পারলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন