প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত বিধিমালা ঘিরে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষা ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৩-এ বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগীয় পদোন্নতির পরিবর্তে সরাসরি নিয়োগের সুযোগ অবারিত করায় ক্ষুব্ধ প্রাথমিকের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। বয়সসীমা ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ এবং বিভিন্ন পদের যোগ্যতা হিসেবে বাধ্যতামূলক বিএড ডিগ্রি বাতিল নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন তারা। সেইসঙ্গে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন পদ বাদ দেওয়া যথাযথ হয়নি বলেও অনেকে মনে করছেন। তাদের মতে, শিক্ষা ক্যাডারের মাঠপর্যায়ের পদগুলো দখলের চিন্তা থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নতুন বিধিমালা তৈরি করেছেন। তবে প্রশাসন ক্যাডারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, সব দিক বিবেচনা করে ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এ বিধিমালা করা হয়েছে।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘বিদ্যমান একটি ক্যাডার সার্ভিসকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে আরেকটি ক্যাডার। শুধু এখানেই নয়, শিক্ষার যতগুলো জায়গা, সবই তারা (প্রশাসন ক্যাডার) দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এতদিন তারাই দখল করেছিল, এখন তারা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়া নিজেরাই বিধি বানিয়ে ফেলেছে। আমরা সবাই বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। সমিতির (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি) পক্ষ থেকে দ্রুত একটা জোরালো অবস্থানে যাব।’
তবে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এমন অভিযোগ বাস্তবসম্মত নয় দাবি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে দায়িত্বরত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষায় ২৩ ধরনের স্টেকহোল্ডার রয়েছেন। প্রত্যেকেই নতুন বিধিমালা তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। আর সরকার দেখেছে সবার কল্যাণ। সবার কথা চিন্তা করে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনসহ সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই নীতিমালা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, শিক্ষার বিভিন্ন পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনও করেছেন তারা। তবে দীর্ঘদিনেও বিষয়টি সুরাহা হয়নি। এরই মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালার বিভিন্ন ধারা সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সহকারী উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে ৫০ শতাংশ পদ শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত থাকত। বাকি ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। নতুন বিধিমালায় ৮০ শতাংশ নিয়োগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে ও বাকি ২০ শতাংশ পদে উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে নিয়োগের বিধান করা হয়েছে; কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত পদে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেই পদও উন্মুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে পূরণের সুযোগ রাখা হয়েছে।
বিধি অনুযায়ী, এটিইও পদে নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে গণ্য হবেন। এক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক হলে কমপক্ষে তিন বছর আর সহকারী শিক্ষক হলে তার কমপক্ষে ১০ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ উন্মুক্ত প্রার্থীরা শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। অবশ্য উন্মুক্ত প্রার্থীদের বয়সসীমা ৩০ হলেও বিভাগীয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা ৪৫ পর্যন্ত শিথিলযোগ্য রাখা হয়েছে।
প্রাথমিকের শিক্ষকরা বলছেন, এটিইওর ৮০ শতাংশ পদ শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক; কিন্তু সেক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে এ পদের নিয়োগ পরীক্ষা শুধু শিক্ষকদের জন্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। তা না হলে শিক্ষকদের অনেকেই এ সুযোগ পাবেন না।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ কালবেলাকে বলেন, ‘নতুন বিধি অনুযায়ী এটিইও পদের নিয়োগ পরীক্ষায় নতুনদের সঙ্গে ১০ থেকে ১৫ বছর চাকরি করা শিক্ষকদের প্রতিযোগিতা করতে হবে। আবার ইউআরসি ইন্সট্রাক্টরের মতো কিছু পদে শিক্ষকরা আবেদনও করতে পারবেন না। এটা অবশ্যই অসংগতি। ৮০ শতাংশ এটিইও পদ বিভাগীয় প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকলে তাদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পুরোনো শিক্ষকরা নবীনদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না।’
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রধান শিক্ষক মো. রিয়াজ পারভেজ বলেন, ‘এটিইও পদে ৮০ শতাংশ শিক্ষকদের জন্য সংরক্ষিত হলেও তাদের পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। এটা তো পদোন্নতি হলো না, সরাসরি নিয়োগই হলো। তাই আমরা এই ৮০ শতাংশ শিক্ষকেরই পদোন্নতি চাই। এ ছাড়া ৪৫ বছর হয়ে গেলে তাকে এই তালিকায় রাখা হচ্ছে না। এটা জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের জন্য অপমানের। তাই আমরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি চাই। তিনি বিধিমালায় থাকা শিক্ষকদের ৪৫ বছরের বয়সসীমা সংশোধন করে তা চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত করা দরকার বলে মত দেন।’
নতুন নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা (টিইও) পদে ৫০ শতাংশ পদ পূরণ হবে বিভাগীয় পদোন্নতির মাধ্যমে। আগে প্রধান শিক্ষকরা বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে এই পদে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী গবেষণা কর্মকর্তা বা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা পদে কমপক্ষে পাঁচ বছরের চাকরি করতে হবে। পদোন্নতির মাধ্যমে উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তারা সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বা শিক্ষা কর্মকর্তা হতে পারবেন। এই সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বা শিক্ষা কর্মকর্তারা আবার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বিধিতে উল্লিখিত চাকরির অভিজ্ঞতা লাগবে। পদোন্নতির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, এমনকি পরিচালক হওয়ারও সুযোগ আছে নতুন নিয়োগ বিধিমালায়। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন অন্যান্য পদে নিয়োগের বিষয়টিও এ বিধিমালায় উল্লেখ আছে। তবে বিধিমালায় বিষয়গুলো সহজ করে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবতা কঠিন বলে মনে করেন অনেক শিক্ষক। তাদের মতে, ওপরের দিকে পদের সংখ্যা কম থাকায় শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ বিভাগীয় প্রার্থীই পদোন্নতি পাবেন না।
প্রাথমিকের কয়েকজন শিক্ষক ও পিটিআই ইন্সট্রাক্টর জানান, নতুন বিধিমালার ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন প্রেষণে বদলির মাধ্যমে বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রেষণে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলির মাধ্যমে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার হওয়ায় মূলত সচিবের হাতেই সম্পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে।
তারা মনে করেন, আইন করে সচিবের হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এই ধারা ব্যবহার করে শিক্ষা ক্যাডারের মাঠপর্যায়ের পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারে দখলে নেওয়া হবে বলেও তাদের আশঙ্কা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন বিধিমালার ৯(১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত ১০ ক্যাটাগরির ৫১২টি পদ ক্যাডার কম্পোজিশন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই পদগুলো নন-ক্যাডারভুক্ত হয়ে গেছে। পদগুলো যখন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত ছিল, তখন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন নন-ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ক্যাডারভুক্ত পদে পদোন্নতির সুযোগ ছিল। এই সুযোগ বাতিল হওয়ায় কর্মকর্তারা বিদ্যমান অধিকার, সুযোগ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবেন।
তারা আরও বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গেজেটেড কর্মকর্তা ও নন-গেজেটেড কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮৫-তে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারসহ অন্যান্য পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক ছিল। ১৯৯৪ সালে ওই নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রি বাদ দেওয়া হলেও সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাধ্যতামূলক ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩-এ সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রায় সব পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতায় শিক্ষাবিষয়ক ডিগ্রি বাদ দেওয়া হয়েছে, যা মানসম্মত শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পিটিআই ইন্সট্রাক্টররা বলছেন, নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত তপশিলের ৬, ৮ ও ১৭ নং ক্রমিক অনুসরণ করলে জ্যেষ্ঠতার নীতি মানা হবে না। এর ফলে একই দপ্তরে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে কনিষ্ঠ কর্মকর্তার অধীনে চাকরি করতে হবে, যা বিশৃঙ্খল কর্ম পরিবেশ তৈরি করবে। এ ছাড়া তপশিলের ১৬ ও ১৭ নং ক্রমিক নিয়ে আপত্তি তুলে তারা বলছেন, এটি একই গ্রেডভুক্ত উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং পিটিআই ইন্সট্রাক্টরদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করবে। তা ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা কর্মকর্তার ৩১টি পদে পদায়নের জন্য ফিডার পদে কেবল উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক মনে করেন তারা।
মন্তব্য করুন