শনিবার (২৩ আগস্ট) দুপুর ২টার কাছাকাছি। প্রিজনভ্যানে করে কারাগার থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে। এ ছাড়া হত্যা মামলায় রিমান্ড শেষে মাইটিভির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সাথীকেও হাজির করা হয়। এরপর তাদের আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়।
ঘড়ির কাঁটায় সময় যখন বিকাল সাড়ে তিনটা। সিএমএম আদালতের হাজতখানার সামনে বন্ধের দিনেও আসামিদের স্বজনদের ভিড়। প্রায় সবাই মাইটিভির চেয়ারম্যান নাসিরের স্বজন ও কোম্পানির কর্মচারী। হাজতখানায় পুলিশের বাড়তি উপস্থিতি। তবে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (সিজেএম) নবম তালায় শুনানি হবে দেখে আসামিদের নিরাপত্তার জন্য আদালতে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রিজনভ্যানে করে সিজেএম আদালতে তোলা হবে। বিকাল ৩টা ৪২ মিনিটে হাজতখানা থেকে দুই মিনিটের পথ পেরিয়ে আনা হয় আনিসুল, মেনন ও মাইটিভির নাসিরকে। প্রিজনভ্যান থেকে নেমে সবাইকে মন মরা দেখা যায়। সবার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে পেছন থেকে পিছমোড়া করে বাঁধা, মাথায় হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।
এরপর লিফটে করে আদালতের নবম তলায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাকিবুল হাসানের আদালতে হাজির করে পুলিশ। ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে তিন আসামিকে কাঠগড়ায় তুলে হেলমেট ও হাতের হাতকড়া খুলে দেওয়া হয়। এরপর তারা দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রথমেই শুনানি শুরু হয় নাসিরের। তার আইনজীবীরা নাসিরের সঙ্গে মেয়ে ও স্ত্রীর কথা বলার জন্য আবেদন করেন। বিচারক কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
বিকেল ৩টা ৫৮ মিনিটে অনুমতি পেয়ে নাসিরের স্ত্রী আসফিয়া উদ্দিন ও মেয়ে কাঠগড়ার পাশে আসেন। নাসিরের মুখে, বুকে হাত বোলাতে থাকেন। অন্যদিকে নাসিরের মেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরেন। তখন সবার চোখ ছলছল করে কাঁদতে দেখা যায়। ৪টা ১ মিনিটের দিকে মেয়ের মাথা বুকের পাশে নিয়ে কপালে একটা চুমু খান নাসির। এরপর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন। এ সময় নাসিরসহ সবাই দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন। অন্যদিকে পাশে দাঁড়িয়ে পেছনে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আনিসুল হক ও মেনন।
এরপর যাত্রাবাড়ী থানার আসাদুল হক বাবু হত্যা মামলায় তিন দিনের রিমান্ড শেষে নাসিরকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক খান মো. এরফান। আদালত তা মঞ্জুর করেন।
অন্যদিকে যাত্রাবাড়ী থানায় মেহেদী হাসান নামে আরেক হত্যা মামলায় আনিসুল হক ও মেননকে ৫ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত সে আবেদনও মঞ্জুর করেন।
পরে বিকেল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে ইনু ও মেননকে বের করা হয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন মাইটিভিসহ কোম্পানির কর্মচারীদের বেতনের জন্য নাসির উদ্দিন সাথীর স্ত্রী আসফিয়া উদ্দিনের নামে বিশেষ ক্ষমতা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিতে স্বাক্ষরের জন্য আবেদন করেন আইনজীবীরা। বিচারক এ সময় শুনানি করতে থাকেন।
অন্যদিকে শুনানি শেষ না হওয়ায় বাইরে প্রায় ৪-৫ মিনিট দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন আনিসুল হক ও রাশেদ খান মেনন। শুনানি শেষে বিচারক একটু পর আদেশ দেবেন বলে এজলাস থেকে নেমে যান।
এদিকে অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে যান আনিসুল হক ও মেনন। তাদের ফের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। এ সময় দেখা যায় নাসির উদ্দিন সাথীকে কাঠগড়ায় একটি টুল দেওয়া হয়েছে। সেখানে বসে আছেন তিনি। আনিসুল হক ও মেনন তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।
এ সময় স্বজন, কর্মচারী ও আইনজীবী মিলে এজলাস কক্ষে তখন প্রায় ৩০-এর অধিক লোক নাসিরের কী লাগবে, কী খাবে তা জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ টিস্যু বাড়িয়ে দেন, কেউ পানি। এগুলো ব্যবহার করেন নাসির উদ্দিন।
অন্যদিকে নাসিরকে তার স্ত্রী আসফিয়া বলেন, বাসা থেকে খাবার রান্না করে এনেছি। খাবে নাহ? তখন নাসির বলেন, আমি খেয়ে এসেছি। এখানে খাওয়া যাবে না। তখন পাশ থেকে একজন বলেন, খাবার আনো। সঙ্গে দিয়ে দিই। তখন নাসির মানা করেন। আর বলেন, আমার ছেলের দিকে খেয়াল রেখ। তোমরাও আমার সন্তানের মতো। এ সময় অনেককে কাঁদতে দেখা যায়।
দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন বয়সে সত্তরোর্ধ্ব আনিসুল হক ও রাশেদ খান মেনন। আনিসুল হক কাঠগড়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘আমরা তো কেরানীগঞ্জে বিশেষ কারাগারে থাকি। আমাদের আটকে রাখছেন কেন। উনি (নাসির) তো যাবেন ভিন্ন জায়গায়। গাড়ি ডেকে আমাদের পাঠিয়ে দিন। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব।’
তখন মেননও পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে একই কথা বলতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘এভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আমাদের নিয়ে যান।’
কিন্তু পুলিশ সদস্যরা জানান, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আনিসুল হক দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে কোমরে হাত দিয়ে পেছনে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ান। মেননও পেছনে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ান।
এ সময় নাসিরকে স্বজনদের যত্ন করা দেখে আনিসুল ও মেনন এজলাসে কাউকে খুঁজতে থাকেন। এ সময় আনিসুল পরিচিত কারও দেখা না পেলেও মেনন পরিচিত একজন নারীর দেখা পান। তখন ওই নারী কাঠগড়ায় এসে মেননের কানে কানে কিছুক্ষণ কথা বলতে থাকেন।
এরপর বিকেল ৪টা ২৮ মিনিটে বিচারক ফের এজলাসে আসেন। এ সময় আনিসুল হক চেয়ারে বসে থাকা নাসিরকে উঠে দাঁড়াতে বলেন। তখন নাসির দাঁড়ান। এরপর শুনানি শেষে বিচারক আইনজীবীদের বলেন, ‘নিয়মিত কোর্টে আমলি আদালতে স্ত্রীকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দিতে আসামির স্বাক্ষরের জন্য আবেদন করুন।’
এরপর ফের কারাগারে নিয়ে যেতে হেলমেট পরানোর সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নাসিরের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, ‘সত্য, প্রোডাকশন কোর্টের এ বিষয়ে আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার নেই।’
এরপর বিকেল সাড়ে ৪টায় তাদের ফের হাতে হাতকড়া, মাথায় হেলমেট পরিয়ে লিফটে করে নিচে নামানো হয়। পরে প্রিজনভ্যানে কেরানীগঞ্জে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
মন্তব্য করুন