‘বাবাই তো আমার সবকিছু ছিলেন। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাবার মতো আইনজীবী নয়, বড় চিকিৎসক হতে হবে; কিন্তু আমি ব্যবসায়ী হওয়ার কথা বলেছিলাম বাবাকে। তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন। ভারতে তীর্থস্থানে ঘুরতে নিয়ে যাবেন আমাকে। সেই বাবাকেই রাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলেছে! আমার বাবার তো কোনো দোষ ছিল না, তিনি নিষ্পাপ-নির্দোষ ছিলেন, তাকে মারল কেন?’
রাজধানীর সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের একমাত্র মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীল হাসপাতালের মেঝেতে বসে এসব বলেই বিলাপ করছিল। এ সময় তাকে সান্ত্বনা দেওয়ারও কেউ ছিল না, পরিবারের অন্য সদস্যরাও বিলাপ করছিলেন চোখের জলে। ভূমিকা চন্দ্র শীল সদ্যই এসএসসি পাস করেছে। নোয়াখালীর মাইজদীতে একটি কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। একমাত্র মেয়েটিকে ঘিরে নানা স্বপ্ন ছিল বাবা ভুবন চন্দ্র শীলের।
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে বিজি প্রেসের সামনের সড়কে ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে প্রাইভেটকারের যাত্রী শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইদ মামুনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা। সেই গুলিতে আহত হন ভুবন চন্দ্র শীল। তখন তিনি ওই সড়কে ভাড়া মোটরসাইকেলে আরামবাগের বাসায় যাচ্ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওই রাতেই তাকে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এতদিন সেখানেই তিনি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর মধ্যে গত শনিবার তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে গতকাল সোমবার সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অসময়ে বাবার এই অনাকাঙ্ক্ষিত চলে যাওয়ার পর মেয়ে ভূমিকা এখন বাবাকে ঘিরে নানা ঘটনা, নানা স্বপ্ন হাতড়াচ্ছে। ‘নির্দোষ বাবাকে মারল কেন?’—মলিন মুখে কিশোরী ভূমিকার সত্য-শক্ত সেই প্রশ্নের জবাব যেন কারও কাছে নেই। ভুবনের স্ত্রী ওই ঘটনায় মামলা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ এক সপ্তাহ পর গতকাল সোমবার রাতে সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে, অন্য সন্ত্রাসীরা এখনো অধরা।
ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীল স্বামীর লাশ ঘিরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। সংবিৎ ফিরে বলছিলেন, একটাই চাওয়া, এভাবে আর কোনো সন্তানের বাবাকে যেন এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে যেতে না হয়। আমার মেয়েটা বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। আজ তার বাবা চলে গেল। তিনি বলেন, আমাদের তো কোনো দোষ ছিল না, আমার স্বামীর কোনো দোষ ছিল না। তাহলে আমি স্বামীহারা হব কেন? আমার মেয়ে বাবাহারা হবে কেন? আমার মেয়েটা এত অভাগা, তার ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না।
ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে দাঁড়িয়ে মেয়ে ভূমিকা জানায়, ৩০ সেপ্টেম্বর তার মায়ের চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল। এবার সঙ্গে তাকেও নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন বাবা। তখন আমরা তীর্থস্থানে ঘুরতে যাব বলে বাবার সঙ্গে পরিকল্পনা করেছিলাম। সবকিছু শেষ হয়ে গেল। এখন আমার মায়ের চিকিৎসা হবে কেমনে?
বাবার স্মৃতি হাতড়ে মেয়ে জানায়, এসএসসি পাস করার পর বাবা ফোনসেট কিনে দিয়েছিলেন। এরপর নানা কথা হতো তার সঙ্গে। আমি খাসির মাংস পছন্দ করায় বাবা তা খেলেই আমাকে ফোন দিতেন।
স্বজনরা জানান, ভুবন চন্দ্র শীল রাজধানীর গুলশানে গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। থাকতেন আরামবাগে। স্ত্রী রত্না রানী শীল মাইজদীর একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুজনের কর্মস্থল আলাদা হওয়ার কারণে ভুবন ঢাকায় থাকতেন। আর স্ত্রী একমাত্র সন্তান ভূমিকাকে নিয়ে থাকেন নোয়াখালীর মাইজদীতে।
ভুবনের শ্যালক পলাশ মজুমদার জানান, নগদ কোনো টাকা ছিল না। এই পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। এরপরও চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করে প্রায় ৮ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেল। এখন তারা দিশেহারা হয়ে গেছেন।
তিনি জানান, ময়নাতদন্ত শেষে ভুবন চন্দ্রের লাশ গ্রামের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজীতে নেওয়া হয়। সেখানেই শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে।
ওই গুলির বিষয়ে পুলিশের ধারণা, শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইদ মামুনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের লোকজন। ওই গুলি লেগেছিল ভুবনের মাথায়। তা ছাড়া এই ঘটনায় তৃতীয় কোনো পক্ষ জড়িত কি না, তাও তদন্ত করা হচ্ছে।
পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুক কালবেলাকে জানান, ওই গুলির ঘটনায় মারুফ বিল্লাহ হিমেল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পরে দেওয়া হবে।
শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, ভুবন চন্দ্রের স্ত্রীর করা মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপান্তর হবে। থানা পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা ওই ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে।
মন্তব্য করুন