বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে সরকার। তাকে কোন দেশের হাসপাতালে পাঠানো যায়, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। সরকারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য বিষয়টি আদালতে পাঠানো হতে পারে। গত সোমবার সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে কয়েকজন মন্ত্রীর বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে বিএনপিও। সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির সভায় এ নিয়ে কথাবার্তা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতির প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে অনেকদিন ধরেই আইনি জটিলতার কথা বলা হচ্ছে। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থা ‘সংকটজনক’ হয়ে পড়ায় বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন নীতিনির্ধারকরা। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত বিএনপি চেয়ারপারসনের খোঁজ রাখা হচ্ছে। অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে কীভাবে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো যায়, তা নিয়ে চলছে চিন্তাভাবনা। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এ ইস্যুতে একটা ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছতে চায় সরকার।
জানা গেছে, খালেদা জিয়া ইস্যুতে আলোচনার জন্য গত সোমবার সচিবালয়ে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার সর্বোচ্চ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা নিয়েও আলোচনা করেন তারা।
শারীরিক জটিলতা বিবেচনায় চিকিৎসার জন্য তাকে কোন দেশে পাঠানো যায়, সে বিষয়েও পরামর্শ করেছেন তারা।
সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকটি দেশের নাম আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে আছে দুবাই, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য বাদে ইউরোপের কোনো দেশে পাঠানোর বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। তবে আইনি প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হওয়ার পর অন্যান্য বিষয় চূড়ান্ত করা হবে।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ইস্যুতে উচ্চ আদালতে রিটের কথা ভাবছে বিএনপি। এ নিয়ে গত সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনার একপর্যায়ে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এই ইস্যুতে উচ্চ আদালতে রিট করা যায় কি না, তা বিবেচনার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অনুমতি দিলে ভালো। আর না দিলে দেশি-বিদেশি সবাই বিষয়টি দেখবে। আমরা যে দীর্ঘদিন ধরে বলছি, আদালত স্বাধীন নয়, এর মধ্য দিয়ে সেটাও আবার প্রমাণিত হবে।’
তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা মনে করেন, যেহেতু নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সে কারণে এখানে আদালতের কোনো বিষয় নেই। সরকারই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দিতে পারে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, খালেদা জিয়া নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পেয়েছেন। উনি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মুক্তি পাননি। অতএব, এখানে আদালতের কোনো বিষয় নেই। পুরোটাই সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার নির্বাহী আদেশে কোনো আসামির কারাবাস স্থগিত করতে পারে। সেটা শর্তযুক্ত অথবা শর্তহীনভাবে। ৪০১ ধারা অনুযায়ী যেহেতু নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, এখন শর্ত উঠিয়ে নিলেই হয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ায় আর কোনো বাধা থাকবে না। বিষয়টি পুরোপুরি সরকারের হাতে।’
এদিকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড অনেক আগেই জানিয়েছে, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। এ রোগের চিকিৎসার জন্য যে ধরনের চিকিৎসা প্রযুক্তি দরকার, তা ভারতীয় উপমহাদেশে নেই। শুধু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা জার্মানির বিশেষায়িত হাসপাতালেই এই জটিলতার চিকিৎসা সম্ভব।
লিভার জটিলতা ছাড়াও ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাসের বেশি সময় ধরে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘বোর্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উনার লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেজন্য তাকে দ্রুত বিদেশে উন্নত মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি সেন্টারে পাঠানো দরকার।’
শারীরিক অবস্থার অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি সামনে এনেছে তার পরিবার ও বিএনপি। এই ইস্যুতে দলীয়ভাবে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা সরকারের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে আলোচনাও করছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়া মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। তার শরীর এতটাই অসুস্থ, ডাক্তাররা বলছেন—অবিলম্বে বিদেশে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। সে কারণে আমরা বলেছি, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিদেশে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় এর সব দায়িত্ব এই সরকারকে নিতে হবে।