দীর্ঘদিন ধরে নাব্য সংকটের মুখে দেশের অন্যতম নদ ব্রহ্মপুত্র। তাই এটিসহ গুরুত্বপূর্ণ চার নদনদী রক্ষায় উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৮ সালে ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভবা নদীর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার’ প্রকল্পের কাজ শুরু করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছর।
সম্প্রতি ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র খনন করে বালু উত্তোলন করা হয়। প্রকল্প কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী ১১৩ কোটি ঘনফুটের বেশি বালু তোলা হয়েছে। যার অর্থমূল্য ২৫০ কোটি টাকার বেশি। অথচ বালু বিক্রি করে মাত্র ১৭ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে জেলা প্রশাসন। বেশিরভাগ বালুর এখন হিসাব নেই কারও হাতেই।
অভিযোগ উঠেছে, জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) অবহেলায় বেশিরভাগ বালুই লুটপাট হয়ে গেছে। রাতের আঁধারে নদীর পাড়ে জমানো বালু বিক্রি করেছে অসাধু মাটি ব্যবসায়ী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এর সঙ্গে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ ঘটনায় দায় নিতে চায় না কেউ। নানা কথা বলে বিষয়টি আড়ালে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, প্রকল্প তাদের হলেও নদী থেকে উত্তোলন করা বালু রক্ষণাবেক্ষণসহ নিলামে বিক্রির দায় জেলা প্রশাসনের। আর উপজেলা পর্যায়ে যেসব স্থানে বালু রাখা হয়েছিল, তা সংরক্ষণ করে বিক্রির দায়িত্ব ইউএনওদের। পুরো কাজের সমন্বয় করবেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। তবে ইউএনওরা এর দায় এড়াতে পারেন না।
বালু লুটপাটের কথা স্বীকার করে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন বলছে, কিছু বালু নিলামে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি হয়েছে। কিছু বালুর টেন্ডার জমা পড়েনি। আবার প্রয়োজনীয় তদারকি ও জনবলের অভাবে কিছু বালু নষ্ট হয়েছে। আশপাশের লোকজন বালু নিজেদের প্রয়োজনে নিয়ে গেছে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র অংশে বরাদ্দ ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। এর বড় অংশই ব্যয়
হয়েছে নদী খননে। তবে খনন করে যে পরিমাণ বালু তোলা হয়েছে, তা বিক্রি করে ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি টাকা আয় করা সম্ভব হতো।
কেন বিপুল অর্থ নষ্ট হলো। এজন্য অবহেলা কাদের বা প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী নদীর বালু সংরক্ষণ ও বিক্রির দায়িত্ব আসলে কাদের? কালবেলার পক্ষ থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। প্রকল্প কার্যালয় ও বিআইডব্লিউটিএ ময়মনসিংহ নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী নদী খননের আগে মাটি ফেলার জন্য জেলা প্রশাসন ও ইউএনওদের কাছে সরকারি খাস জায়গা চাওয়া হয়। তাদের দেখানো জমিতে খনন করা মাটি অথবা বালু রাখা হয়। পরে সরকারি একাধিক দপ্তর যৌথ জরিপ করে মাটির পরিমাণ ঠিক করার পর নিলামে বিক্রি করা হয়।
জানা গেছে, টোক থেকে ময়মনসিংহ সদর পর্যন্ত নদীর পাড়ে রাখা বালু দেখভালের দায়িত্ব ছিল সাত ইউএনওর। এসব উপজেলার মধ্যে রয়েছে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর ও পাকুন্দিয়া, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, নান্দাইল ও ময়মনসিংহ সদর। পুরো বালু বিক্রির দায়িত্ব ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের হাতে ছিল। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, নদী খননের পর বালু রাখার স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে বেশিরভাগ বালু লুটপাট করেছে স্থানীয় মাটি ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত লোকজন। রাতের আঁধারে ট্রাক দিয়ে বালু বিক্রি করেছে মাটি ব্যবসায় নিয়োজিত একাধিক প্রভাবশালী চক্র। অভিযোগ আছে, সরকারিভাবে দেখভালের দায়িত্বে থাকা সবাই এ অপকর্মের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত। মাটি বিক্রির দায়ে কারও বিরুদ্ধে কোনো পক্ষ থেকেই মামলা হয়নি। বিক্রির সঙ্গে যুক্ত কারও নামের তালিকাও নেই জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়। মাটির বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকাদের বিষয়ে ভাসা ভাসা তথ্য সরবরাহ করেছে সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) মোহসিন মিয়া কালবেলাকে বলেন, টোক থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৭৯টি স্পটের মধ্যে ৪৯টিতে যৌথ সার্ভে করে নিলামে বালু বিক্রি করেছে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। তিনি বলেন, ড্রেজিং শেষে বালু রাখার পর নানা কারণে ৩০ ভাগ কমে যায়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এসব বালু দেখভাল ও বিক্রির দায়িত্বে। আমার জানা মতে কিছু বালু বিক্রি হয়নি। হয়তো পর্যায়ক্রমে বিক্রি হবে। নদীর পাড়ে কিছু বালু নষ্ট হয়েছে। তবে লুটপাটের অভিযোগ কানে আসেনি। ২০টি স্পটে যৌথ সার্ভে করে বালুর পরিমাণ ঠিক করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য স্পটের বিষয়ে আমার জানা নেই।
কোথায় গেল বালু?
বিআইডব্লিউটিএর সূত্রের দাবি, টোক থেকে ময়মনসিংহ অভিমুখে উজানের দিকে ৭৯টি স্পটে এ পর্যন্ত ১১৩ কোটি ১২ লাখ ৪৬ হাজার ৫৮০ সিএফটি (ঘনফুট) বালু খনন করা হয়েছে। স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের পরামর্শে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে খাস জমিতে বেশিরভাগ বালু ফেলা হয়।
ময়মনসিংহ জেলার ৪৯টি স্পটে খননের বালু রাখা হয় ২৯ কোটি ২৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭৭২ সিএফটি। ২০টি স্পটের বালু এখনো পরিমাপ করা হয়নি। বাদবাকি ১০টি স্পটের বালুর অবস্থা সম্পর্কে কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। তা ছাড়া বালুর পরিমাণ নিয়ে জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএর তথ্যে ব্যাপক গরমিল রয়েছে।
বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, সাধারণত খুচরা পর্যায়ে জমি ভরাটের বালু প্রতি ফুট ৪ টাকা দরে বিক্রি হয়। নিলামে ২ থেকে আড়াই টাকা দর ওঠে। এই হিসাবে মোট উত্তোলন করা বালু বিক্রি করে ২৫০ কোটি টাকার বেশি আয় করা সম্ভব ছিল।
জানা গেছে, ময়মনসিংহ সদরে ২৭টি স্পটের মধ্যে ২৪টিতে ১০ কোটি ৭১ লাখ ৯৯ হাজার ৫৬৫ সিএফটি বালুর হিসাব রেখেছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, জেলার ৪৮টি স্পট থেকে ২৫ কোটি ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৬ সিএফটি বালুর হিসাব রয়েছে। জেলার ৭৯ স্পটের মধ্যে মাত্র ১১টির ইজারা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ১৭ কোটি ৩৯ লাখ ৩৭ হাজার ৭০০ টাকা। বাকি কিছু স্পটের ইজারায় কোনো সাড়া মেলেনি বলে দাবি জেলা প্রশাসনের।
ময়মনসিংহ সদরে ২৪ স্পটের মধ্যে ইজারা হয়েছে মাত্র চারটির। এসব স্পট থেকে বালু বিক্রি হয়েছে ৩ কোটি সিএফটির কিছু বেশি। অথচ বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসনের সূত্র জানিয়েছে, ময়মনসিংহ সদরে বালু ছিল প্রায় ১১ কোটি সিএফটি। বাকি প্রায় ৮ কোটি সিএফটি বালুর হদিস নেই! ইজারা হয়নি এমন স্পটের বালুই সবচেয়ে বেশি লোটপাট হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মপুত্র পারের ইপিজেডে পাঁচ কোটি সিএফটি বালু সরবরাহ নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন। ব্রহ্মপুত্র খননের পর থেকে বালু বাণিজ্যে একটি মাফিয়া চক্র জড়িত।
সূত্র জানায়, রাতের অন্ধকারে বালু বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ ও বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্র ও বালু সিন্ডিকেট জড়িত। স্থানীয় প্রভাবশালীদের পেটেও গেছে এ বালু বিক্রির টাকা। প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক সাঈদুর রহমান দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বালু লুটপাট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএ প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার কালবেলাকে বলেন, আমি ফেব্রুয়ারি থেকে প্রকল্পের দায়িত্বে নিই। নতুন পিডি যুক্ত হয়েছেন। তবে ময়মনসিংহ শহরের অংশে আবারও ড্রেজিং করা হবে। আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে বালু রাখায় জায়গা চেয়েছি। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ হাতে আছে মাত্র এক বছর। এই সময়ে কোনোভাবেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও, ত্রিশাল, গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ ও সদর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদ খননের বালু সবচেয়ে বেশি লোটপাটের খবর পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পারভেজুর রহমান খননের বালু নিয়ে অব্যবস্থাপনাসহ চুরির কথা স্বীকার করে জানান, লোকবলের অভাবে স্থানীয় প্রশাসন থেকে সব স্পটে নজরদারি করতে না পারায় এমনটি হয়েছে। তবে কী পরিমাণ বালু চুরি হয়েছে এবং সরকারের কত টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, তা জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা। বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, আমার বদলির অর্ডার হয়েছে। তবুও বালু লুটপাটের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। উপজেলা কর্মকর্তাদের গাফিলতির বিষয়ে কোনো জবাব দেননি তিনি।
মন্তব্য করুন