রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ থেকে চাঁদ উদ্যান হাউজিং এলাকার প্রধান সড়ক। দূরত্ব আনুমানিক দেড় কিলোমিটার। কিছু এলাকা ফাঁকা, তবে বেশিরভাগেই আছে দোকানপাট। যানবাহনের সঙ্গে সড়ক ধরে মানুষের হাঁটাচলাও আছে সবসময়ই। সেই পথটুকুতেই গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিভীষিকা দেখেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। দা-চাপাতি উঁচিয়ে একদল তরুণ-কিশোরের দৌড়াদৌড়ি, যাকে সামনে পাচ্ছিল তাকেই কোপাচ্ছিল তারা। এরপর পকেট হাতিয়ে মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় তারা। ওই দিন সন্ধ্যা পৌনে ৭টা থেকে অন্তত ৪০ মিনিট ধরে চলে এই তাণ্ডব।
ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা রয়েছেন আতঙ্কে। সবকিছু জানলেও কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তারা বলছেন, ওই সন্ধ্যার তাণ্ডব চালিয়ে অন্তত ৩০ জনের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয় তরুণ-কিশোরের দুর্বৃত্ত দলটি। তাদের মধ্যে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন অন্তত ১০ জন। ৪০ মিনিটের ওই তাণ্ডব ধরা পড়েছে সিসিটিভি ক্যামেরাতেও।
স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, স্থানীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন জুনিয়র নেতা ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য গণছিনতাইয়ের নেতৃত্বে ছিল। তারা সবাই মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাজ্জাদ রহমানের অনুগত। এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বছিলা গার্ডেন সিটি এলাকায় একই কায়দায় গণছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীরা তখন পথচারীসহ রাস্তার পাশের অন্তত ২০টি দোকানের মালপত্র লুট করে ও ভাঙচুর চালায়। তখনো নাম এসেছিল সাজ্জাদের।
অবশ্য সাজ্জাদ রহমান কালবেলাকে বলেন, গত বুধবার পর্যন্ত তিনি পারিবারিক কাজে নোয়াখালী ছিলেন। তিনি ছাত্ররাজনীতি করেন, ছিনতাই বা এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। কেউ হয়তো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তার নামটি বারবার জড়াচ্ছে। স্থানীয় জহুরা মঞ্জিল এলাকার একজন দোকানি বলেন, এই গ্রুপকে এলাকার সবাই চেনে। তার মতো অনেকের সামনেই গণছিনতাই চলছিল অস্ত্র উঁচিয়ে আর কুপিয়ে। আতঙ্কে কেউ মুখ খোলেনি, খুলবেও না। মাঝেমধ্যেই এমনটা ঘটে বলে স্থানীয় লোকজন তথ্য দেন।
সেদিন সন্ধ্যার তাণ্ডবে গণছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে কালবেলা। তাদের একজন বেড়িবাঁধ এলাকার একটি মোটরস শোরুমের নিরাপত্তাকর্মী মো. সাব্বির। তিনি বলেন, ডিউটি শেষে তিনি জহুরা মঞ্জিল এলাকায় বাসায় ফিরছিলেন। চাঁদ উদ্যান
গেট এলাকায় পরিচিত একজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তিনি। তখন ৮ থেকে ১০ জনের একটি দল দৌড়ে এসে তাকে ধরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোপাতে থাকে। পরে মোবাইল ও তিন হাজার টাকা নিয়ে যায়।
সাব্বিরের মা সাফিয়া খাতুন বলেন, আমার ছেলেকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে। হাতে, পায়ে কুপিয়েছে, বাঁ হাতের একটা আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে বাসায় আছে। তিনি জানান, ঘটনার পরদিন থানায় অভিযোগ দিয়েছেন; কিন্তু পুলিশ তাকে কিছুই জানায়নি।
আরেক ভুক্তভোগী মোহাম্মদপুর সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজের ছাত্র হাসান মাসুদ। ছিনতাইকারীরা তার বাঁ পায়ে কুপিয়েছে। মাসুদ বলেন, তিনি চাঁদ উদ্যান গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ করেই ১০ থেকে ১২ জন চাপাতি নিয়ে তাকে কুপিয়ে মোবাইল ফোন ও ৪ হাজার টাকা নিয়ে যায়।
কালবেলার হাতে থাকা ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে স্থানীয়রা অস্ত্রধারী কয়েকজনকে শনাক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে একজন মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত জুয়েল ওরফে ভোলা জুয়েল ওরফে সোর্স জুয়েল, কিশোর গ্যাং ‘সোহাগ গ্রুপের’ সোহাগ ওরফে টেইলার্স সোহাগ, সাব্বির, সোহেল, আরিফ ওরফে গাল কাটা আরিফ, নিঝুম, আশরাফ মিরাজ, আলী, এনামুল ও রতন নামে এই ১১ জনকে চিনতে পারেন।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সেদিন সন্ধ্যার পর ৮-১০ জনের একটি দল বেড়িবাঁধের ভাঙা মসজিদের দিক দিয়ে অস্ত্র হাতে হেঁটে যাচ্ছে। পথে যাকে পাচ্ছে তার সব ছিনিয়ে নিচ্ছে। কেউ দিতে না চাইলে তাকে কুপিয়ে আহত করছে। অবশ্য প্রকাশ্যে দেড় কিলোমিটারজুড়ে এমন গণছিনতাইয়ের কথা পুলিশ জানেই না!
গতকাল শুক্রবার মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক ভূঞা কালবেলাকে বলেন, তাদের কাছে একজন ভুক্তভোগী এসেছিলেন। মামলা নেওয়ার পর দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মঙ্গলবারের ছিনতাইয়ে ছাত্রলীগের স্থানীয় কয়েকজন কর্মী ও কিশোর গ্যাংয়ের নাম আসার বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদেই বাকিদের নাম বেরিয়ে আসবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোহাম্মদপুর এলাকায় বারবার এ ধরনের ঘটনার বিষয়ে ওসি বলেন, ঘটনা ঘটলেও পুলিশ বসে নেই। জড়িতদের আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। আগেও ডাকাতির মামলা নিয়ে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।