মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দরবারে পৌঁছাইতেই তাহার চোখ পড়িল মন্ত্রীর দিকে। তিনি হুঙ্কার দিয়া বলিলেন,—মন্ত্রী, তোমার তো এখন এখানে থাকার কথা নয়। তোমার তো কথা ছিল যে দেশে আমাকে তুমি সপরিবারে নির্বাসনে পাঠানোর চক্রান্ত করেছিলে, সেখানে থাকার!
—মহারাজ, আমি তো যাওয়ার জন্য সব গোছগাছ করেই রেখেছিলাম কিন্তু এর মধ্যে যে আরেকটা ব্যাপারের কথা সেনাপতি জানাল, যে জন্য আর রওনা হতে পারলাম না।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অতিশয় ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,
—কী এমন কথা যা তুমি আমাকে না জানিয়েই নিজে নিজেই আমার নির্দেশ অবজ্ঞা করলে! বলো, এক্ষুনি বলতেই হবে এখানে। না হলে তোমাকে আমি শূলে চড়াব।
মন্ত্রী কম্পিতকণ্ঠে কহিল—
—মহারাজ, মুর্শিদাবাদ থেকে একটা গোপন সংবাদ পাওয়া গেছে, সেটা আপনাকে জানিয়েই তারপর আমি যাত্রা শুরু করতাম।
—কী সেই গোপন সংবাদ?
—মুর্শিদাবাদের নবাব নাকি অনেক চেষ্টা করেও আপনাকে সরাতে না পেরে কৃষ্ণনগরে একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন।
—কীসের ব্যবস্থা? কী জিনিস সেটা?
সবাই বেশ চিন্তিত, কেহ মাথা চুলকাইতেছেন, কেহ ঘাড়ে হাতের তালু ঘষিতেছেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র জানিতে চাহিয়াছেন নির্বাচন মানে কী, এ জানাটা তাহার জন্য নিশ্চয়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্যথায় নবাব হঠাৎ কৃষ্ণনগরের ওপর চড়াও হইতে পারেন, মহারাজ মহারানীকে একটা বড়সড় বিপদের মধ্যেও ফেলিতে পারেন এবং ইহাতে তাহাদের প্রাণ সংশয় পর্যন্ত ঘটিবার আশঙ্কা আছে—এইসব সাত-পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে রাজসভার অধিকাংশই ব্যাকুল হইয়া উঠিল।
গোপাল ভাঁড় উঠিয়া দাঁড়াইয়া মহারাজকে প্রণাম জানাইয়া বলিল,
—মহারাজ, সবেই এত ভেঙে পড়েছেন কেন, আসুন সবাই আনন্দ করি, নাচ-গান করে মনকে প্রফুল্ল রাখি। মন্ত্রী মশাই মুর্শিদাবাদ থেকে গোপন সংবাদ জেনে এসেছেন, এ তো আমাদের সকলের জন্য একটা নতুন ঘটনা।
মন্ত্রী বিরক্ত হইয়া বলিলেন,
—থামো তো গোপাল। তোমার সব ব্যাপারেই ভাঁড়ামি! একটা বিপদ নেমে এসেছে কৃষ্ণনগরের মাথার ওপর আর তুমি কি না নাচ-গান-ফুর্তি করার কথা বলছ!
কৃষ্ণচন্দ্র—সত্যি তো গোপাল, তুমি এসব ব্যাপার এত হালকাভাবে নিচ্ছ? যদি ওইসব বাইরের লোক তা সে নবাবই হোক আর দিল্লির বাদশাহই হোক, যদি ওইসব কিছু চাপিয়ে দেয় এখন আমাদের কী উপায় হবে ভেবেছ একবার?
গোপাল—মহারাজ, আগে আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমাদের মন্ত্রী মশাই তো সবসময় ঘুরঘুর করেন একটা মতলব মাথায় নিয়ে।
মন্ত্রী—বড্ড বাজে কথা বলছ তুমি গোপাল। তুমি জানো আমি কী করতে পারি তোমার?
গোপাল—কী আর করবেন মন্ত্রী মশাই আপনার ওই কটা-ঘটা দিয়ে? চুপ করে বসুন, শান্ত হয়ে গান শুনুন, যদি মন চায় তবে গানের সঙ্গে নাচতেও পারেন।
মন্ত্রী—ফাজলামো হচ্ছে! মহারাজ, আপনার ওই আদরের বাঁদরটাকে সামলান, নইলে একটা লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে বলে দিচ্ছি।
কৃষ্ণচন্দ্র—কী শুরু করলে তোমরা? থামো, থামো সব!
গোপাল—গানটা একটু শুনাই মহারাজ, আপনার মনটা প্রফুল্ল হবে।
কৃষ্ণচন্দ্র একটু থামিয়া বলিলেন, আচ্ছা শুনাও। গোপাল শুরু করিল।
‘আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে
ঘাড় নামাব না কোনোমতেই বিদেশি শর্তে—
কৃষ্ণনগরের রাজার রাজত্বে...’
মন্ত্রী ছাড়া সবাই এ গানের সঙ্গে গলা মিলাইতে থাকিলেন আর মন্ত্রী ভুরু কুঁচকাইয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিলেন। একটু পরে বিরক্তির সুরে বলিলেন,
—মহারাজ, তাহলে আর গোপন সংবাদ নিয়ে কথা না বলি।
কৃষ্ণচন্দ্র—বলো, বলো মন্ত্রী, নির্বাচন না কী যেন একটা কথা বলছিলে—বলো সেই কথাটা—
মন্ত্রী—মহারাজ, মুর্শিদাবাদের নবাব খুব অধীর হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণনগরে একটা কিছু করার জন্য। আপনার তো বয়স হয়েছে, কোন দিন কী হয় সেই ভাবনায় নবাব বাহাদুর অস্থির।
কৃষ্ণচন্দ্র—কেন, আমার আবার কী হবে! বেশ তো আছি।
গোপাল—শুধু আপনি নন মহারাজ, কৃষ্ণনগরের প্রত্যেকটা মানুষও বেশ খুশি। তাদের এখন তো কোনো অভাব নেই। মহারাজের কৃপায় এখন কৃষকের মুখে হাসি আছে, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছে, জেলেরা মাছ ধরছে, কারও কোনো অভিযোগই নেই। আপনার কানে কোনো সমস্যা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনি তো তার সমাধানই করে দিচ্ছেন, তাহলে বাইরের লোকেরইবা এত মাথাব্যথা কেন আর মন্ত্রী মহাশয়েরইবা এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কী আছে?
মন্ত্রী—দেখো গোপাল, এ দেশের সবার জন্য আমার ভালোবাসাও বেশি আর তাই দায়িত্বও বেশি।
গোপাল—আহা, আপনি বুঝি ভালোবাসার আনন্দে গরিব মানুষদের গলা জড়িয়ে ধরেন পা দিয়ে—
মন্ত্রী—দেখলেন, দেখলেন মহারাজ, গোপাল আমাকে কেমন অপমান করছে।
সভাকবি—মহারাজ, আমার একটা কবিতা মাথায় এসেছে, বলব?
মহারাজ—হ্যাঁ, বলো বলো শুনি—
মন্ত্রী—একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার মধ্যে আবার কবিতা-ফবিতা কেন?
মহারাজ—আহা মন্ত্রী, তুমি থামবে? কবির একটা কবিতা মাথায় এসেছে, সেটা যদি এখন না বলতে পারে, তাহলে তো সেটা মাথা থেকে উড়ে যাবে, বলো, বলো সভাকবি—
সভাকবি—আমরা করব না তো ভয়
যতই বাধা আসুক
আমাদের হবে জয়
রাজসভার সকলে উল্লাস প্রকাশ করিল আর মন্ত্রী বিড়বিড় করিয়া বলিলেন—
—যতসব আদিখ্যেতা! আমি দেখাচ্ছি খেল তখন বুঝবে ঠ্যালা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন