রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যেও বড় কোনো অঘটন ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এবার তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। মার্চের প্রথমার্ধ থেকেই পর্যায়ক্রমে সারা দেশে অনুষ্ঠিত হবে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ স্তরের নির্বাচন। গতবারের মতো এবারও কয়েক ধাপে এ নির্বাচন আয়োজন করা হবে। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে সার্বিক প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসি। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং রোজার মাস বিবেচনায় নিয়ে করণীয় ঠিক করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্যেও সরকারের ‘স্বতন্ত্র’ কৌশলের কারণে জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীকের উপজেলা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলাই হবে কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। উপজেলা নির্বাচনে যাতে দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্ররা সক্রিয় থাকতে পারেন কমিশনকে সে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন হওয়ায় সহিংসতা রোধ করে আচরণবিধি প্রতিপালন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এবারের জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে আচরণবিধি লঙ্ঘনের রীতিমতো হিড়িক পড়েছিল। কমিশন শুরুর দিকে এ নিয়ে উদাসীন থাকলেও নানা সমালোচনার মুখে শেষ দিকে কঠোর অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে রেকর্ডসংখ্যক শোকজ, তলব, জরিমানা, মামলা এবং কারও কারও প্রার্থিতাও বাতিল করা হয়। এসব এড়িয়ে নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে। উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের হওয়ায় সেক্ষেত্রে সংহিসতার মাত্রা আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য ইসিকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে এটিও নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জের জায়গা বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন কেমন হতে পারে, তা জাতীয় নির্বাচনে ফুটে উঠেছে। আসলে বিরোধীপক্ষের বড় রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই জাতীয় নির্বাচনের মতো অনেক রাজনৈতিক দল উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। কারণ, এটি স্থানীয় নির্বাচন হলেও তা দলীয় প্রতীকেই হচ্ছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ের নির্বাচন হওয়ায় সারা দেশেই সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে। সেটি মোকাবিলা করতে হবে কমিশনকে। আর জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে দেশ-বিদেশে যে প্রশ্ন উঠেছে, উপজেলা নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।’
স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদের মেয়াদ হচ্ছে প্রথম সভা থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। আইনের ১৯৯৮-এর ১৭(১) (গ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ থেকে পূর্ববর্তী ১৮০ (একশ আশি) দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৯ সালের মার্চে পাঁচটি ধাপে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার একযোগে ৪৮৮টি উপজেলা পরিষদের তপশিল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ৪৫৫টির নির্বাচন ঘোষিত সময়ে এবং বাকিগুলোর পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছর ১০ মার্চ প্রথম ধাপে ৭৮টি, ১৮ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ১১৬টি, ২৪ মার্চ তৃতীয় ধাপে ১১৭টি, ৩১ মার্চ চতুর্থ ধাপে ১০৭টি এবং ১৮ জুন পঞ্চম ধাপে ২০টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হয়। বেশকিছু নির্বাচন মামলার কারণে আটকে ছিল। সে হিসাবে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় গণনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে; তাই শপথও হয়েছে পাঁচ বা তার বেশি ধাপে। কাজেই উপজেলাগুলোর মেয়াদও কয়েক ধাপে শেষ হবে। আর সে অনুযায়ী ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় গণনা হবে। গতবারের মতো এবারও ধাপে ধাপে উপজেলায় ভোট গ্রহণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত রয়েছে। সেজন্য সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও কেনা হয়েছে।
জানা গেছে, কোন উপজেলায় কবে ভোট হয়েছে, কবে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে—স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে সেসব তথ্য চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও এ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সবমিলিয়ে এখন ৪৮৫টি উপজেলা নির্বাচনযোগ্য বলে তথ্য পেয়েছে কমিশন। এসব উপজেলার নির্বাচন সফলভাবে শেষ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার বলেছেন, ‘নির্বাচনের যোগ্য উপজেলার তালিকা পেয়েছি। কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হবে। নির্বাচন ধাপে ধাপে, নাকি একবারে হবে, তা কমিশনের বৈঠকে চূড়ান্ত হবে। এসএসসি পরীক্ষা, রোজাসহ সার্বিক দিক বিবেচনা করা হবে। সম্ভবত রোজার আগেই এ নির্বাচন শুরু হতে পারে। যখন যেভাবেই হোক, সেই অনুযায়ী কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে রোজার মাসে নির্বাচন কম হওয়ার প্র্যাকটিস আছে। সেক্ষেত্রে প্রথম ধাপের ভোট হয়তো রোজার আগে হতে পারে, পরবর্তী ধাপ ঈদের পরে হতে পারে। আগামী সপ্তাহে কমিশনের অনুমোদন পেলেই তপশিল ঘোষণা করা হবে।’
সূত্র জানায়, উপজেলা নির্বাচনের সূচি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষা ও রোজা গুরুত্ব পাচ্ছে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে চলবে ১২ মার্চ পর্যন্ত। অন্যদিকে রমজান শুরু হতে পারে ১৩ মার্চ। আর এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হতে পারে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে। সেজন্য পরীক্ষা ও রোজার মধ্যে নির্বাচন কীভাবে এড়ানো যায়, সেই কৌশল নিয়ে কাজ করছে কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এ ক্ষেত্রে উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ নিয়ে দুই রকম চিন্তা করছে কমিশন। প্রথমত, রোজার আগে মার্চের শুরুতে প্রথম ধাপের ভোট করে বাকি ভোট রোজার পরে করা। দ্বিতীয়ত, রোজা শেষ করে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে ধাপে ধাপে ভোট করার চিন্তা রয়েছে কমিশনের।
জানা গেছে, মার্চে ভোট হলে এ মাসের শেষ দিকে তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে। আগামী সপ্তাহে কমিশন বৈঠকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। যদিও ইসির প্রাথমিক চিন্তা হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা ও রোজা শেষেই এ নির্বাচন আয়োজন করা। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে কমিশনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের ওপর।