হাসান আজাদ
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ০৭:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাইপলাইনে গ্যাস ‘হাওয়া’

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সরবরাহ করেছে ৯ হাজার ২৯৮ কোটি ঘনমিটার। বিতরণ কোম্পানিগুলো পেয়েছে ৮ হাজার ৮০৬ কোটি ঘনমিটার। উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত পাইপলাইনে ‘হাওয়া’ হয়ে গেছে ৪৯২ কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস! গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস বা পদ্ধতিগত ক্ষতির বাইরে বিপুল পরিমাণ এ গ্যাস স্রেফ চুরি হয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা—পাইকারি দরেই যার মূল্য কমপক্ষে ৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) এক প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

দেশে গ্যাস সংকট সামাল দিতে উচ্চমূল্যে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করছে সরকার। সেইসঙ্গে চলছে সিস্টেম লস কমিয়ে আনার চেষ্টা। এর আগে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য সিস্টেম লসের গ্রহণযোগ্য মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তবে এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গ্যাস চুরির প্রবণতা থামছে না।

দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাসের সরবরাহ এবং বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পাওয়া বিলের গরমিল নিয়ে গত মে মাসে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে গ্যাসের উৎপাদন, সরবরাহ এবং এর বিপরীতে কী পরিমাণ গ্যাসের বিল পাওয়া গেছে, সেই হিসাব নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে তিন বছরে সরবরাহ করা হয়েছে ৯ হাজার ২৯৮ কোটি ৮৬ লাখ ৭ হাজার ৬৭২ দশমিক ৬৯ ঘনমিটার বা ৩২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮৮ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে ৮ হাজার ৮০৫ কোটি ৮৪ লাখ ৫৭ হাজার ২১৪ দশমিক ৮৯ ঘনমিটার বা ৩১ লাখ ৯ হাজার ৭৫৫ দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন ঘনফুটের বিল পাওয়া গেছে।

বাকি ৪৯২ কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার ৪৫৭ দশমিক ৮০ ঘনমিটার বা ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩৩ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের বিপরীতে কোনো বিল পায়নি পেট্রোবাংলা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সর্বশেষ আদেশ অনুযায়ী, ইনটেক পয়েন্টে পাইকারি গ্যাসের দাম প্রতি ঘনফুট ১১ টাকা ৯১ পয়সা। সেই হিসাবে ‘উধাও’ হয়ে যাওয়া গ্যাসের মোট মূল্য দাঁড়ায় ৫ হাজার ৮৬২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

এ অবস্থায় প্রথমবারের মতো গ্যাসের সিস্টেম লস ও চুরি বন্ধে বিল প্রদানের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনছে পেট্রোবাংলা। পরিবর্তনটি হলো, বিতরণ কোম্পানিকে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হবে, গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস ছাড়া বাকি গ্যাসের টাকা পরিশোধ করতে হবে। পেট্রোবাংলার লোকসান কমাতে, বিতরণ কোম্পানিগুলোর চুরি বন্ধে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘আগে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাস সরবরাহের বিপরীতে তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো বিল পরিশোধ করত। এতে লোকসান অনেক হতো এবং কোনো জবাবদিহি ছিল না। এখন থেকে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হবে, সে পরিমাণ গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লসের বিষয়টি আমলে নেওয়া হবে।’ নতুন বিলিং পদ্ধতি কবে নাগাদ কার্যকর হতে পারে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এ পদ্ধতি চালু হলে সিস্টেম লস বা চুরি একেবারেই কমে যাবে।’

পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যে পরিমাণ গ্যাসের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি, তা মূলত বিতরণ কোম্পানিগুলো সিস্টেম লস হিসেবে দেখালে এটা মূলত চুরি। বর্তমানে তিতাসের অনুমোদিত বা গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস ২ শতাংশ। এ ছাড়া অন্য কোম্পানিগুলোর অনুমোদিত সিস্টেম লস নেই। বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা পরস্পরের যোগসাজশে এ চুরি করেন। এ ছাড়া অবৈধ সংযোগও রয়েছে।

তারা বলেন, বর্তমানে দেশে গ্যাসের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। দেশীয় কূপ থেকে অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিসহ এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এ অবস্থায় এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে জ্বালানি সরবরাহ দিন দিন কমে যাবে। তাই সিস্টেম লসের নামে মূল্যবান গ্যাস যাতে নষ্ট করতে না পারে, সেজন্য স্থায়ী সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পেট্রোবাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১—এ তিন অর্থবছরে কে ৫ হাজার ৩৩১ কোটি ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭১ দশমিক ৬০ ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এর বিপরীতে ৪ হাজার ৯১০ কোটি ১৫ লাখ ১৯ হাজার ২৯ ঘনমিটারের বিল পরিশোধ করেছে কোম্পানিটি। ৪২১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫৪২ দশমিক ৬০ ঘনমিটার গ্যাসের বিল পাওয়া যায়নি। কোম্পানিটির অনুমোদিত সিস্টেম লস ২ শতাংশ ছাড়াই সিস্টেম লস বা চুরির পরিমাণ ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ।

বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড উল্লিখিত তিন বছরে গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে ১ হাজার ৮৭ কোটি ৮৭ লাখ ৭৮ হাজার ৫৫৪ দশমিক ৭৭ ঘনমিটার। এর বিপরীতে বিল পরিশোধ করেছে ১ হাজার ৪৬ কোটি ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯৭৯ দশমিক শূন্য ৫ ঘনমিটার। ৪১ কোটি ৮২ লাখ ২২ হাজার ৫৭৫ দশমিক ৭২ ঘনমিটারের বিল পাওয়া যায়নি, যা সরবরাহকৃত গ্যাসের ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড উল্লিখিত তিন বছরে গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে ১ হাজার ১৭৩ কোটি ১ লাখ ২৪ হাজার ২০১ ঘনমিটার। এর বিপরীতে বিল পরিশোধ করেছে ১ হাজার ১৬৭ কোটি ৫২ লাখ ৪২ হাজার ৫৬০ ঘনমিটার। ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৮১ হাজার ৬৪১ ঘনমিটারের বিল পাওয়া যায়নি, যা সরবরাহকৃত গ্যাসের শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড উল্লিখিত তিন বছরে গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে ৯৬৩ কোটি ২৫ লাখ ৭ হাজার ৯৮১ ঘনমিটার। এর বিপরীতে বিল পরিশোধ করেছে ৯৫৫ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার ৯৪২ দশমিক ৯৬ ঘনমিটার। ৮ কোটি ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৩৮ দশমিক শূন্য ৪ ঘনমিটারের বিল পাওয়া যায়নি, যা সরবরাহকৃত গ্যাসের শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড উল্লিখিত তিন বছরে গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে ৪৫৬ কোটি ৭০ লাখ ৬৭ হাজার ৩১৪ ঘনমিটার। এর বিপরীতে বিল পরিশোধ করেছে ৪৪২ কোটি ৫০ লাখ ৬৬ হাজার ৯০২ দশমিক ৭৬ ঘনমিটার। ১৪ কোটি ২০ লাখ ৪১১ দশমিক ২৪ ঘনমিটারের বিল পাওয়া যায়নি, যা সরবরাহকৃত গ্যাসের ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।

সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড উল্লিখিত তিন বছরে গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে ২৮৫ কোটি ৬০ লাখ ৫ হাজার ৫০ দশমিক ৩২ ঘনমিটার। এর বিপরীতে বিল পরিশোধ করেছে ২৮৪ কোটি ৪০ লাখ ৬১ হাজার ৮০১ দশমিক ১২ ঘনমিটার। ১ কোটি ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ২৪৯ দশমিক ২০ ঘনমিটারের বিল পাওয়া যায়নি, যা সরবরাহকৃত গ্যাসের শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস চুরি এক-তৃতীয়াংশ কমানো গেলে বিদেশের স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে হয় না। আর তা হলে দামও বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে। এটা থামাতে হলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ঘাড়ে সিস্টেম লসের দায় চাপাতে হবে। এ টাকা সরকার দেবে না।’

তিনি বলেন, ‘বিতরণ কোম্পানিগুলো সিস্টেম লস রাখতে চাইছে। কারণ, এতে তাদের চুরি করতে সুবিধা হয়। বর্তমানে তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লস ২ শতাংশ। আমি এ ২ শতাংশও রাখার পক্ষে না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভারতে আটক পুলিশ কর্মকর্তা আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি

ক্রিকেট ম্যাচে ওভার না দেওয়ায় গুলি, ২ ভাই নিহত

জামায়াত আমিরের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে বাসায় গেলেন ইসহাক দার

ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদপ্রার্থীসহ দুজনের প্রার্থিতা বাতিলের সুপারিশ

লাইনচ্যুত বগি রেখেই ছেড়ে গেল ট্রেন

‘এটা কি আমার বাপের টাকায় করেছে? আমার নাম কেন থাকবে’

রুমিন ফারহানার বক্তব্যের ‘কড়া’ জবাব হাসনাতের

চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে ট্রেন বিলম্বে যাত্রীদের বিক্ষোভ

খালেদা জিয়া নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য : বুলু

সিংহ শিকারের জন্য বেরিয়ে আসে, মোদিকে ওপেন চ্যালেঞ্জ বিজয়ের

১০

‘বাইরে থেকে লোক এসে দেশে সড়ক বানিয়ে দেয়, এটা লজ্জার’

১১

বাংলাদেশ পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা ভারত থেকে আটক

১২

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর সরকারি ছুটি কবে?

১৩

শ্রাবন্তীর লেহেঙ্গায় মুগ্ধ ভক্তরা

১৪

শুক্র-শনি ছুটিসহ এনজিওতে চাকরির সুযোগ

১৫

এইচএসসি পাসেই চাকরি দিচ্ছে আকিজ গ্রুপ, পাবেন আবাসন সুবিধাও

১৬

একাদশে ভর্তির তৃতীয় পর্যায়ের আবেদন কবে?

১৭

মাঠের করুণ অবস্থা দেখে কান্না চলে আসছে : বুলবুল

১৮

আরও ১৪ জেলেকে অপহরণ করল আরাকান আর্মি

১৯

ব্রাজিলে বেড়ে ওঠেও আর্জেন্টিনার জার্সিতে স্বপ্ন দেখছেন তরুণ ফুটবলার

২০
X