প্রকৃত ভালোবাসা নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন হলেও সর্বজনবিদিত ভালোবাসার এই রূপ একেকজনের কাছে একেকরকম। এটা কখনো রোমান্টিক হয় এবং কখনো হয় পরোপকারী আকারের। এ ক্ষেত্রে রোমান্টিক রূপ যুগল ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরোপকারী আকারের ভালোবাসা প্রকাশিত হয় সর্বজনবিদিত। যেটি শুধু কল্যাণের অনুভূতি দেয় এবং যেখানে প্রকাশ পায় সদিচ্ছা, দয়া, সহানুভূতি, পরোপকারীভাবে কাজ এবং সেবা করার মানসিকতাকে। অর্থাৎ এর ঐকান্তিক কামনা থাকে, অন্যরা বা সবাই সুখী থাকুক। অর্থনীতিবিদ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মনতোষ চক্রবর্তী ভালোবাসার রূপকে ঠিক এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন।
অন্যদিকে এই পরোপকারী ভালোবাসার মধ্যেও অর্থনীতিকে টেনে এনেছেন আরেক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। এ বিষয়ে ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও ভালোবাসার অর্থনীতি’ শিরোনামে তার দীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধে তিনি দাবি করেছেন, প্রত্যেক পরিবারে নারীর গৃহস্থালির সব কাজে ভালোবাসা থাকে, যেখানে তার একটা সুপ্ত অর্থমূল্য থাকে, যা একান্তই আপনজন ছাড়া অন্য কারও থেকে নিতে হলে সেই অর্থমূল্যের টের পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার ওই প্রবন্ধে হিসাব করে দেখিয়েছেন, ‘ভালোবেসে’ বাংলাদেশের ১০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী নারীরা গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডে বছরে ব্যয় করেন ১৬ হাজার ৬৪১ কোটি শ্রমঘণ্টা। আর এই শ্রমঘণ্টার বার্ষিক অর্থমূল্য হবে আনুমানিক ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। ভালোবাসার অর্থনীতির এ পরিমাপটি তিনি করেছেন ১৫ বছর আগে ২০০৮ সালের অর্থমূল্য ধরে।
এতে দাবি করা হয়, প্রতিটি পরিবারে নারী শত ধরনের গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডে শ্রম দেন। যেমন, কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি উৎপাদনে নারীর অবদান ৫০ শতাংশ। তারা গ্রামে ফসল চাষ, ধান ঝাড়াই, তুষ ছাড়ানো-শুকানো, ধান সেদ্ধ করা, ধানের বীজ সংরক্ষণ, খাবার পানি সংগ্রহ করা, হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল পালন, দুধ দোয়ানো, জ্বালানি সংগ্রহ, রান্নাবান্না প্রভৃতি কাজ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ও সৃজনশীলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। একই নারী পরিবারের শিশু ও প্রবীণদের যত্নআত্তি করেন। এখনকার সময় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা মায়েরাই দিয়ে থাকেন। মায়েরাই আবার এসব শিশুকে স্কুলে আনা-নেওয়া করে আসছেন। এসব সময়ের অর্থমূল্য জিডিপিতে যোগ করার বিষয়ে আবুল বারকাত নানা যৌক্তিকতাও তুলে ধরেছেন।
এমন বাস্তবতায় ড. বারকাত বলেছেন, ‘ভালোবাসার অর্থনীতির’ আর্থিক মূল্য যোগ করলে দেশে হিসাবকৃত যে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হবে, তার প্রায় ৪৮ শতাংশই হবে নারীর অবদান। কিন্তু তা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে নারীর এই অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
তথ্যমতে, আজকের সময়ের ভালোবাসার অর্থনীতির পরিমাপ কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে—জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত কালবেলাকে বলেন, ‘আমি যখন এই গবেষণাটি করেছিলাম, তখনকার অর্থনীতি আর আজকের বাস্তবতার অনেক তফাৎ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে চলতি মূল্যে টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এই পুরো জিডিপিতে নারীর ভালোবাসার কাজের অংশগ্রহণ যদি সর্বনিম্ন ২০ শতাংশও ধরা হয়, তাহলেও দেখা যাবে আজকের অর্থনীতিতে তার মোট অর্থমূল্য দাঁড়াবে ১০ লাখ ১ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা।
ভালোবাসার অর্থনীতি সম্পর্কিত সর্বশেষ তথ্য সমৃদ্ধ বিস্তৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তিনি নতুন করে আলোচনায় টেনে এনেছেন ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক বৃহদাকারের আরেক গবেষণা গ্রন্থে।
এতে তিনি দাবি করেছেন, পরিবারের মায়েরাই এই স্বেচ্ছাশ্রম বেশি দেন। তারা সবার আগে ঘুম থেকে ওঠেন এবং সবার পরে ঘুমাতে যান, অর্থাৎ পরিবারের জন্য সারা বছর দৈনিক গড়ে কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা শ্রম দেন। দাবি করেন, এই জননী উচ্ছিষ্ট খেয়ে
অপুষ্টি-পুষ্টিহীনতার দুষ্টচক্রে জীবন চালিয়ে দিতে বাধ্য হন। তার এ প্রক্রিয়ার শুরু নারী হিসেবে জন্মগ্রহণের দিন থেকে নয়, জন্মগ্রহণের আগেই মাতৃগর্ভে। প্রয়োজনীয় খাদ্য-পুষ্টির অভাব নিয়েই তার জন্ম; আর এভাবেই পেরিয়ে যায় তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন; অর্থাৎ পুরো জীবনচক্র।
এদিকে নারীর ভালোবাসার কাজের এই স্বীকৃতি অর্থমূল্য আকারে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্তির দাবি করে আসছে সুশীল সমাজের পাশাপাশি নারীবাদী বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনও। জানা গেছে, বিষয়টি আমলে নিয়ে গত ১১ এপ্রিল, ২০২৩ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ সংক্রান্ত একটি অনুশাসন দেন। যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অর্থনীতিতে ঘরের কাজ বা গৃহস্থালি কাজের অবদান স্বীকার করতে হবে। এটা করা গেলে আমাদের জিডিপি আরও বাড়বে। ঘরের কাজের আর্থিক মূল্যায়ন আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে জিডিপিতে কীভাবে যুক্ত করা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করতে বিবিএস ও বিআইডিএসকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়।’
তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে বিআইডিএসে একটি প্রাথমিক গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বিষয়টি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও দেখেছে। কিন্তু জিডিপির হিসাবে নারীর এই সেবামূলক কাজের বা ভালোবাসার অর্থনীতির অর্থমূল্য আপাতত জিডিপিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন কালবেলাকে জানান, ‘আমরা যে জিডিপি তৈরি করি, তাতে আমাদের দেশীয় কোনো পদ্ধতি বা মডেল অনুসরণ করা হয় না। এটি জাতিসংঘ প্রটোকল মেনে সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে জিডিপির হিসাব করা হয়। সারাবিশ্বেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। সব দেশ একরকমই করে থাকে। নতুবা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যায় না।
গৃহস্থালিতে শ্রমের আর্থিক মূল্যমানের পরিমাপ সম্পর্কে তিনি বলেন, নারীর গৃহস্থালিতে শ্রমের আর্থিক মূল্যমানের পরিমাপে অনেক দেশেই অনেক ধরনের গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু এখনো কোথাও এ পরিমাপটি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সিদ্ধান্ত জাতিসংঘ নেয়নি। সেটি এখনো প্রাথমিক ও যাচাই-বাছাই অবস্থাতেই রয়েছে। এটা অন্তর্ভুক্ত করতে হলে আগে একটা আন্তর্জাতিক ফর্মুলা আসতে হবে। এটা চাইলেও আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো প্রয়োগ করতে পারব না। ফলে আপাতত এটি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ কম। তবে আমরা প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন মেনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।