নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলামের চলতি দায়িত্বে নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হলে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য নতুন উপাচার্য নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষকে চলতি দায়িত্ব দিতে হবে। তবে সেই নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে ১৮ মাসের চলতি দায়িত্ব দিয়েছে এনএসইউর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি)। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেতরে-বাইরে চলছে সমালোচনা।
অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে চলতি দায়িত্ব দিয়ে এনএসইউ ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান জাভেদ মুনির আহমেদের পাঠানো মেইলের কপি কালবেলার হাতে এসেছে। সেখানে তিনি লিখেছেন–‘এনএসইউ’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে উপাচার্যের অন্তর্বর্তী পদের জন্য মনোনীত করেছি, যা তিনি গ্রহণ করেছেন। এই নিয়োগ ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।’
এনএসইউ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পেয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে প্রথম মেয়াদে যোগদান করেন অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নর্থ সাউথের উপাচার্য হন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়। এর আগেই তাকে তৃতীয় মেয়াদে ১৮ মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়ার আবেদন জানিয়ে বিওটি থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে এটি অনুমোদন হয়ে আসছে না দেখে বিওটি স্বপ্রণোদিত হয়ে তাকে ১৮ মাসের জন্য উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব দেয়। বিওটি উপাচার্যের চলতি দায়িত্ব দিতে পারে কি না, জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ গত শনিবার কালবেলাকে বলেন, তিনি (অধ্যাপক আতিকুল) দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, ছুটিতে থাকবেন।
অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম গত রোববার এক অফিস আদেশে লিখেন- ‘আমি ব্যক্তিগত কারণে ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত ছুটিতে থাকব। কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রব খান আমার অনুপস্থিতিতে রুটিন জিনিসগুলো স্বাক্ষর করবেন।’ এই আদেশের নিচে তিনি স্বাক্ষর করেছেন ‘উপাচার্য ইনচার্জ’ হিসেবে।
অনেকেরই যুক্তি, আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনচার্জ’ নামে কোনো পদ নেই। যতক্ষণ না আচার্য কাউকে উপাচার্য ঘোষণা করছেন, উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এর আগে ট্রাস্টি বোর্ড তিনজনের একটি প্যানেল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করবেন।
ইউজিসির এক কর্মকর্তা বলেন, নর্থ সাউথের উপাচার্যকে ১৮ মাসের জন্য নিয়োগ দিতে বিওটি থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি পাঠানো হয়। এটি তারা করতে পারেন না। উপাচার্য হিসেবে পূর্ণ মেয়াদের জন্যই তাকে নিয়োগের সুপারিশ করতে হবে। আবার বিওটি চেয়ারম্যান তাকে চলতি দায়িত্ব দিয়েছেন। এটিরও কোনো সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী এটি তিনি করতে পারেন না। উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ৩১ (৬) ধারায় বলা হয়েছে ‘উপাচার্য কোনো কারণে তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অস্থায়ীভাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্যের পদ শূন্য থাকলে কোষাধ্যক্ষ উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করিবেন।’ ১৬ (৯) ধারায় বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অংশে বলা হয়েছে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য যথাক্রমে, ধারা ৩১, ৩২ ও ৩৩-এর বিধান সাপেক্ষে আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পেশ করবেন।’
এনএসইউ সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে তৃতীয়বার ৪ বছর মেয়াদের জন্য সুপারিশ না করতে পেরে নিয়ম ভেঙে ১ বছর ৬ মাসের (১৮ মাস) জন্য সুপারিশ করেছে। এই ব্যাপারে বোর্ডের যুক্তি হলো আরেকজন উপাচার্য আনতে হলে এক বছরের বেশি সময় লাগবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবারের বেশি কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না। এনএসইউ সেখানে ‘ওয়ান ম্যান শো’। বিশ্ববিদ্যালয়টি ভিসিসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। সে কারণে এখানে উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। আবার এখানে বিওটিও কার্যকর নয়।
বিষয়টি নিয়ে এনএসইউ ট্রাস্টি বোর্ডের তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়েছে কালবেলার। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ইয়াসমিন কামাল কালবেলাকে বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে তাকে (অধ্যাপক আতিকুল) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে বিওটি চেয়ারম্যান এই বিষয়টিতে যারা উপস্থিত ছিলাম, তাদের জানিয়েছেন।
আরেক সদস্য মোহাম্মাদ মুস্তাফা হায়দার বলেন, বিওটি অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে চলতি দায়িত্ব দিয়েছে বলে শুনেছি। যদিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। কোন আইন মেনে এটি করা হয়েছে, তারাই ভালো বলতে পারবেন।
এক বিওটি সদস্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কোষাধ্যক্ষ রয়েছেন। তাকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া তৃতীয়বারের মতো উপাচার্য হিসেবে কাউকে অনুমোদন দেওয়ার রেওয়াজ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। প্যানেল ছাড়া একই ব্যক্তিকে তৃতীয়বারের মতো নিয়োগ দানের চেষ্টার পেছনে একটি মহলের দুরভিসন্ধি রয়েছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলামকে একাধিকবার কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। মোবাইল কলের পাশাপাশি অনলাইনে (হোয়াটসঅ্যাপ) কল দেওয়া হলেও তিনি কল কেটে দেন। পরে সুমাইতা হাসান নামে একজন কল করে জানান উপাচার্য প্রতিবেদকের কলের বিষয়ে অবহিত। তিনি উপাচার্যের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে প্রতিবেদককে জানাবেন। দুদিন অতিবাহিত হলেও তিনি কিছুই জানাননি।
এনএসইউ ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান জাভেদ মুনির আহমেদ বর্তমানে ফিলিপাইনে অবস্থান করছেন। হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে তিনি কেটে দেন। পরে পরিচয় পাঠালে তিনি সেটি দেখেও সাড়া দেননি।
জাভেদ মুনির আহমেদের বড় ভাই ড. জুনায়েদ কামাল আহমেদ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। তিনি থাকেন আমেরিকায়। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে তার নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেওয়া হলে তিনি সেটি দেখলেও সাড়া দেননি। কল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইউজিসি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, বিওটি উপাচার্য হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দিতে পারে না। শুধু উপাচার্য নিয়োগের জন্য নাম সুপারিশ করতে পারে। উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষ থাকলে তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্রপতি উপাচার্য নিয়োগ দেবেন চার বছরের জন্য।