দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রায় এক বছর ধরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কে নানা টানাপোড়েন চলছিল। ভোটের পর কূটনীতির পাশাপাশি বাণিজ্য ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন। তবে নতুন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠি সেই আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ঘুরে গেল যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। তিন দিনের এই সফর বৈশ্বিক পরাশক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নবযাত্রার সূচনা বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে আসে গত শনিবার। বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠকের মধ্য দিয়ে গতকাল সোমবার সফরটি শেষ করেছেন তারা। প্রতিনিধিদলে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর আইলিন লাউবাকার, ইউএসএইড সহকারী প্রশাসক ও এশিয়া ব্যুরোর কর্মকর্তা মাইকেল শিফার এবং যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার।
সফরকালে তারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পাশাপাশি বিরোধী দলের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি তারা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব, শ্রমিক নেতা কল্পনা আক্তার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তারা অতীতের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একসঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরুর কথা বলেন। আবার যখন সরকার বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন, তখন সরকারের নানা দুর্বলতাও তুলে ধরেছেন।
গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ পরিচালক আইলিন লাউবাকার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে এসেছে। অভিন্ন অগ্রাধিকার ও ভবিষ্যতে একযোগে কাজ করার পথ নিয়ে আলোচনা করতে পারা আমাদের জন্য আনন্দের।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় কীভাবে তারা সহায়তা করতে পারে এবং বাংলাদেশে কীভাবে বিনিয়োগ বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করার বিষয়ে উভয় পক্ষের আগ্রহ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
তবে নির্বাচন, নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
একই দিন রাজধানীর গুলশানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন প্রতিনিধিদল। সেখানে আগামী পঞ্চাশ বছর এবং এর পরের সময়গুলোতেও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র উন্মুখ হয়ে আছে বলে জানান তারা।
পরে ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বার্তায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস জানায়, ‘৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের সঙ্গে অংশীদারত্ব করে আসছে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি দিয়েছে দেশটির সরকার।’
যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তারের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক হয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর। সেখানেও কোনো রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি বলে জানান মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন সরকার আগামী পাঁচ বছর ধরে থাকবে। তারা এ সরকারকে সহযোগিতা করতে চায়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের বিষয়গুলো কীভাবে দেখছি, এটা তারা জানতে চেয়েছে।’
প্রতিনিধিদলটির সঙ্গে চার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং আইসিটিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত আমাদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দলের চারটি বড় ইস্যু নিয়ে কথা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা, রফতানি ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং যুবকদের জন্য স্মার্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা।’
এর আগে সফরের প্রথম দিন (শনিবার) বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন প্রতিনিধিদল। ওই বৈঠক সম্পর্কে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বৈঠক শেষে দলটির বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক আমীর খসরু বলেন, ‘তারা আমাদের দাওয়াত করেছেন, আমরা এসেছি। এর বেশি কিছু বলার নেই।’
অবশ্য মার্কিন দূতাবাস জানায়, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক দৃশ্যপট এবং কারাগারে থাকা বিরোধী দলের হাজার হাজার কর্মীর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে। আগামী দিনেও এ সম্পৃক্ততা চলমান থাকবে।’
একই দিনে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ কেমন—তা জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নাগরিক সমাজ কাজের ক্ষেত্রের বিষয়েও জানতে চেয়েছে দেশটি। এ সময় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলার প্রসঙ্গও আলোচনায় আসে।
সেদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর রামপুরায় শ্রমিক নেতা কল্পনা আক্তারের সংগঠন বাংলাদেশ সেন্টার ফর সলিডারিটির কার্যালয় পরিদর্শন করেন মার্কিন প্রতিনিধিরা। সেখানে বাংলাদেশের বিদ্যমান বর্তমান শ্রম আইন ও তার প্রয়োগসহ নানা ইস্যুতে দুপক্ষের কথা হয়।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের এ সফর সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমেরিকা সবসময় তাদের স্বার্থের বিষয়টিই দেখবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও নিজেদের স্বার্থ দেখতে হবে। তারা যদি আমাদের দেশে ব্যবসা করতে চায়, তাহলে দেখতে হবে কিসে তারা বিনিয়োগ করবে। এখন অনেক দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাইবে। কারণ ভূ-রাজনৈতিকভাবে এখন বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। একইভাবে আমেরিকাও চাইবে। কিন্তু তারা আলাদাভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেবে, কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করে, সে অবস্থায় বাংলাদেশ এখন নেই। কারণ অনেক পরাশক্তিই এখন আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়।’
সফরের প্রথম দিনেই বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘এটা আমেরিকার পুরোনো পলিসি। বিরোধীদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে তারা সরকারকে এক ধরনের চাপে রাখতে চায়। আবার বিরোধীদেরকেও নিজেদের হাতে রাখার জন্য খুশি রাখতে চায়। শুধু সরকারের সঙ্গে দেখা করলে তাদের উদ্দেশ্য সফল হতো না।’
তবে বিরোধীরা যদি মনে করে, আমেরিকার মাধ্যমে তারা কোনো সুযোগ নেবে তাহলে সেটি সম্ভব হবে না উল্লেখ করে এই অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমাদের স্বার্থ আমাদেরই দেখতে হবে। এক্ষেত্রে আমেরিকা যদি ভালো কোনো প্রস্তাব দেয়, সেটি গ্রহণ করতে হবে। তবে কোনো ধরনের চাপে কোনো কিছুতে রাজি হওয়া যাবে না। বাংলাদেশকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি মেনে আমাদের সামনে এগোতে হবে। এতদিন যখন পার হয়ে এসেছি, আমাদের অবশ্যই ভালো একটি ভবিষ্যৎ রয়েছে।’