শাহ আলম খান
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৪ এএম
আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভোক্তার সামনে চতুর্মুখী সংকট

আজ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস
ভোক্তার সামনে চতুর্মুখী সংকট

সপ্তাহ খানেক আগেও বাজারে বিভিন্ন জাতের আপেল মিলত সর্বোচ্চ আড়াইশ টাকায়। সাদা আঙুর পাওয়া যেত ২৪০-২৬০ এবং কালো ৩০০-৩৫০ টাকায়। কিন্তু দেশে বিক্রেতাদের মধ্যে এখন রমজানের ধুয়ো লেগেছে। সেই ছুঁতোয় ওই আপেলই কিনতে এখন ক্রেতা-ভোক্তাকে গুণতে হচ্ছে ৩০০-৩৬০ টাকা। একইভাবে সাদা আঙুরে দিতে হচ্ছে ৩০০-৩৫০ এবং কালোয় ৪০০-৪৫০ টাকা।

শুধু এই তিনটি পণ্যই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অত্যাবশ্যকীয় এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। খেয়াল-খুশিমতো সব ধরনের করপোরেট পণ্যেরও দাম বেড়েছে ধারাবাহিক। এমন বাস্তবতায় দেশে ক্রেতা-ভোক্তার অধিকার কতটা সুরক্ষিত, তার নমুনা চলমান বাজার পরিস্থিতির একটু পর্যালোচনাতেই সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠার কথা!

তবে বিষয়টি এখানেই থেমে থাকছে না। দিন দিন ছোট হচ্ছে পণ্যের আকার। বাড়ছে দাম, কমছে গুণগতমান। রয়েছে নকল-ভেজালের অভিযোগ। থেমে নেই মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা খাদ্যের বেচাবিক্রি। ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যের গ্যারান্টি এবং ওয়ারেন্টির নামেও আছে প্রতারণা। প্রযুক্তি ব্যবহারে ডিজিটাল প্রতারণা এ ক্ষেত্রে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ঠকবাজির ব্যবসা চলছে ইট ও এমএস রডের মতো ইমারত নির্মাণ উপকরণেও।

এ ছাড়া সেবা-সার্ভিসের নামে ইন্টারনেট, পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি এবং বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের চিত্র আরও ভয়াবহ। এসব ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতা বা ভোক্তার প্রতিরোধ বা প্রতিকারের পাওয়ার ক্ষেত্রও খুব সংকুচিত। আর নিরাপদ খাদ্যের অনিশ্চয়তা তো

এখন ভোক্তার নিত্যসঙ্গী। বাস্তবতা হচ্ছে—যারা ঠকাচ্ছে, তারাও এই বাজার ব্যবস্থা থেকেই কোনো না কোনোভাবে ঠকছে। কারণ, এখানে শুধু ক্রেতা বা সেবা গ্রহীতাই নন, একমাত্র ভোক্তা নন; বরং উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহকারীও ভোক্তার কাতারে পড়েন। ফলে তারাও অসহায়ের মতো ঠকছেন অন্যের কাছে।

দেশীয় প্রেক্ষাপটে এমন বাস্তবতাকে সঙ্গী করেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ ১৫ মার্চ, শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। বিশ্বব্যাপী ভোক্তার অধিকার সুরক্ষায় এই দিনটি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রতি বছর কনজ্যুমারস ইন্টারন্যাশনালের (সিআই) উদ্যোগে প্রতি বছর বিশ্বের ১২০টি দেশে ২৪০টিরও বেশি সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতি বছরই বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসটি পালন করে আসছে। এবার কনজ্যুমার্স ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক দিবসটির নির্ধারিত প্রতিপাদ্য অনুসরণে বাংলাদেশে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি, ভোক্তার স্বার্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করি’। এ উপলক্ষে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আজ দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।

বর্তমানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দেশে আইন হয়েছে। সংস্থা হয়েছে। তাদের নিয়মিত কার্যক্রমও চলছে। এতে কিছুটা হলেও ভোক্তা সচেতনতা বাড়ছে। মিলছে খানিকটা প্রতিকারও। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিভিন্ন খাতে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের যে হিড়িক, সে তুলনায় দায়িত্বশীল সংস্থার কার্যপরিধি খুবই সীমিত। যেটুকু আছে, সেখানেও স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপে প্রায় সময় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী কিংবা করপোরেট মাফিয়ারা। ফলে ভোক্তার সুরক্ষায় দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানটি কাজ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিয়মরক্ষার দায়িত্বের বাইরে যেতে পারছে না।

অন্যদিকে, গুণগত সেবা-সার্ভিস নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য সংস্থাগুলোর চোখ-কান থাকতেও অন্ধ-বধির অবস্থা। এতে পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে ভোক্তা অধিকার। ফলে পকেট কাটা যাচ্ছে ক্রেতার। জুতসই সেবা পাচ্ছেন না সেবাগ্রহীতারা। এভাবে ক্রেতা ও ভোক্তা এবং সেবাগ্রহীতা সবাই অসহায় হয়ে পড়েছেন।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালবেলাকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আর্থ-সামাজিক প্রায় সব সূচকের বিস্ময়কর উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু সেই উন্নতির সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছেনি। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে দুর্বলতা এর অন্যতম কারণ। করপোরেট সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটলেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের মতো মনোবৃত্তি ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখনো তৈরি হয়নি। ফলে ভোক্তারা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। কিন্তু সবার মনে রাখা দরকার, আমরা সবাই ভোক্তা। কেউ চাই না এমন অসহায়ত্বের মধ্যে চলতে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। সরকার ভোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যে আইন করেছে, সে ব্যাপারে ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, পণ্যের দামে ন্যায্যতা, ভেজাল ও ওজনে কারচুপিসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তর সোচ্চার রয়েছে। প্রতিদিন দেশব্যাপী ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সাধারণ ভোক্তা সচেতন হয়ে কোনো অনিয়ম পেলে আমাদের কাছে অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। জটিল কিছু না হলে আমরা অভিযোগ পেলে দুই সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করছি।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ২০০৯ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিভিন্ন ধারায় অধিদপ্তর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপরাধগুলো হলো ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা, ওজনে কারচুপি, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি, মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি ইত্যাদি।

এ বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান দাবি করেন, ভোক্তারা এখন তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হচ্ছেন। তাদের কাছে কোনো প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা আদায় করলে বা কোনোভাবে ঠকালে তারা অধিদপ্তরে অভিযোগ করছেন এবং তার সুফলও পাচ্ছেন। এ ছাড়া ভোক্তারা যাতে তাদের আইন ও অধিকারের বিষয়ে জানতে পারেন, এর জন্য আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করছি। এর মাধ্যমেও ভোক্তারা আরও সচেতন হয়ে উঠছেন।

অবশ্য ভোক্তাদের সচেতন হয়ে ওঠার প্রমাণ মেলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জমা পড়া অভিযোগের খতিয়ান দেখে। আবার ভোক্তা সুরক্ষায় অধিদপ্তরের কর্মতৎপরতাও অনেক বেড়েছে। সূত্রমতে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় বিভিন্ন অপরাধে গত ১ জুলাই ২০২২ থেকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত এক বছরেই ১১ হাজার ৬৭০টি বাজার তদারকি হয়েছে। এর মাধ্যমে ২৫ হাজার ৬৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ সময় ১ হাজার ৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ কোটি ৬২ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা আরোপ এবং আদায় করা হয়েছে। অন্যদিকে, শুধু ভোক্তার কাছ থেকে সরাসরি অভিযোগ পাওয়া গেছে ২৫ হাজার ৬০৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ১৯ হাজার ৫৩৮টির। যেখানে গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অভিযোগ ছিল মাত্র ৬৬২টি। বর্তমানে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ক্রেতা-ভোক্তাকেই।

এদিকে ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবেই জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) যৌথভাবে দিবসটি পালন করছে। এ উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৮টায় র্যালি বের করা হবে। এ ছাড়া রয়েছে আলোচনা সভা। সারা দেশে দিবসটি ঘিরে অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে।

দিবসটি পালনের রূপকার হচ্ছে বিশিষ্ট পরিবেশবাদী ও ভোক্তাদের অধিকার বিষয়ে আন্দোলনে সোচ্চার কর্মী মালয়েশিয়ার আনোয়ার ফজল। তিনি ১৯৮৩ সালের ১৫ মার্চ ভোক্তা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ভোক্তাদের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতার উদ্দেশ্যে বৈশ্বিকভাবে উদযাপনের আহ্বান জানান। এর আগে ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তব্য দেন। এতে নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার—ভোক্তাদের এ চারটি মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন, যা পরবর্তী সময় ভোক্তা অধিকার আইন নামে পরিচিতি পায়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রুমিন ফারহানাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ

খুলনার রাজনীতির মাঠে সক্রিয় বিএনপি নেতা পারভেজ মল্লিক

সরকারি অফিসে হোয়াটসঅ্যাপ-পেনড্রাইভ নিষিদ্ধ করল জম্মু ও কাশ্মীর

মমতাজের পর এবার আদালতে জুতা খোয়ালেন তৌহিদ আফ্রিদি

ক্যাম্পাসে সহনশীল রাজনীতি চায় ছাত্রদল : আবিদুল

বগুড়ায় স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন শীর্ষক আঞ্চলিক ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত

সব পাথর কোয়ারিগুলো ইকো ট্যুরিজম করার নির্দেশ

জকসু নির্বাচনের আগে বিচার চায় জবি ছাত্রদল

প্রোডাক্ট বিভাগে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিচ্ছে শিক্ষা

চীনের সহযোগিতা বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে : ইউজিসি চেয়ারম্যান

১০

ইলিশের উৎপাদন কমার কারণ জানালেন প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

১১

জকসু নির্বাচন ঘিরে ছাত্রশিবিরের ৫ দফা

১২

ভারতে নির্মিত হচ্ছে ‘পরীমণি’, তবে কে এই পরী?

১৩

বক্তব্যের ভুল ধরতে ফজলুর রহমানের আহ্বান

১৪

মাত্র ১৪ হাজার টাকা আবেদন ফি-এ মালয়েশিয়ায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ

১৫

অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায় আর নেই

১৬

খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাবার ছবি দেখিয়ে আফ্রিদির জামিন চাইলেন আইনজীবী

১৭

যুক্তরাজ্যে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত

১৮

আইনজীবী আলিফ হত্যা মামলায় ৩৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ

১৯

গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের হামলা, সাংবাদিকদের দেখেই ফেলল বোমা

২০
X