রয়েছে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। রেলের জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন খামারবাড়ি। ভূমি দখল, প্রতিপক্ষের লোকজনের ওপর হামলা-মামলা ও কারাগারের ভেতরে গিয়ে দুই যুবলীগ নেতাকে হত্যার হুমকি, মাদক ও ভারতীয় চিনি-তেল, মোটরবাইকসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এ রকম নানা অপরাধে যার নাম জড়িয়ে আছে, তিনি হারুন মজুমদার। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ছিলেন স্থানীয় আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানও। এত শত অনিয়ম ও অপরাধ করেও অপ্রতিরোধ্য তিনি। বহালতবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এলাকায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই নেমে আসে হামলা-নির্যাতন; মামলা দিয়ে হয়রানি।
সম্প্রতি রেলের জায়গায় খামারবাড়ি নির্মাণ করে নতুনভাবে আলোচনায় আসেন হারুন মজুমদার। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেনী থেকে বিলোনিয়া হয়ে ভারতের আসাম পর্যন্ত রেলপথ চালু হয় ১৯২৯ সালে। কিন্তু ১৯৯৭ সালে যাত্রীস্বল্পতার কারণে রেলপথটি বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দিয়ে রেলপথের প্রায় ২ কোটি টাকা সমমূল্যের জায়গা দখল করে নিজের খামারবাড়ি গড়ে তোলেন হারুন। সেখানে আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেন। এর দুটিতে রয়েছে শতাধিক গরু। একটি ঘরে রয়েছে ঘোড়াও। তা ছাড়া রেললাইনের দুই পাশের পুকুরে চলছে মাছ চাষ। খামারে আছে দেশি-বিদেশি জাতের হাঁস-মুরগি, কবুতর ও টার্কি। রেলের জমি দখল করে ঘর নির্মাণের অভিযোগে গত বছরের ২৫ অক্টোবর হারুন মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তার পরও তাকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা যায়নি।
ভয়ভীতি দেখানো, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ হারুন মজুমদারের একটি লাইসেন্সকৃত শটগান রয়েছে। কিছু হলেই এই অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ভয় দেখান তিনি। যদিও বার্ষিক আয়কর ১ লাখ টাকার কম দেখিয়ে পেয়েছেন অস্ত্রের লাইসেন্স। অথচ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা অনুযায়ী, পিস্তল/রিভলবার/রাইফেলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৩ লাখ টাকা এবং শটগানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১ লাখ টাকা আয়কর দেখাতে হবে।
এদিকে ফেনী কারাগারের কনডেম সেলের ৩ নম্বর কক্ষে ঢুকে যুবলীগের দুই নেতাকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ছিল হারুন মজুমদারের বিরুদ্ধে। ওই দুই নেতা হলেন জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এম আজহারুল হক ওরফে আরজু এবং জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া। তারা পৃথক চিঠিতে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করেন। অভিযোগের সত্যতাও মেলে।
চোরাকারবারির হোতা মাদক, কাপড়, মোটরসাইকেলসহ ভারতীয় পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে হারুন মজুমদারের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে তার বাড়ির পরিত্যক্ত গ্যারেজ থেকে ১ হাজার ১৭১ পিস শাড়ি ও থ্রিপিস উদ্ধার করেছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। সম্প্রতি আনন্দপুর সীমান্তে ১৬৯ বস্তা চিনিসহ একজনকে আটক করে পুলিশ। এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এলে প্রবাসী ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। স্থানীয়রা বলছেন, পূর্বশত্রুতার জেরে হান্নান নামে ওই ব্যক্তিকে ফাঁসিয়েছেন হারুন মজুমদার।
সার্টিফিকেট জালিয়াতি ফুলগাজী উপজেলার হাসানপুর দারুল উলুম আলিম মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার জন্য ভুয়া এসএসসি ও এইচএসসি সার্টিফিকেট দাখিল করেন হারুন মজুমদার। তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এমন অভিযোগ দায়ের করেছেন স্থানীয়রা। সর্বশেষ ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে হলফনামায় নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হওয়ার জন্য এসএসসি ও এইচএসসি পাসের সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন তিনি।
অভিযোগপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত সার্টিফিকেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হারুন মজুমদারের দাখিল করা এসএসসি সনদ মতে, তিনি সিন্দুরপুর এস আর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেন। অথচ ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞান বিভাগ চালু করার জন্য বোর্ডে আবেদন করে ১৯৯৪ সালে এবং অনুমোদন পেয়েছে ১৯৯৫ সালে। এদিকে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছেন—এমনটাই দাবি তার। সার্টিফিকেট সিরিয়াল নং-১০৪০০২। অথচ ১৯৯৫ সালে ফেনী কলেজের রেজিস্টারে বিজ্ঞান বিভাগের সিরিয়াল নং ছিল ১১২৫৬৪-১১২৯৫০। হারুন মজুমদারের নির্বাচনী হলফনামা ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যমতে, তার জন্ম ১৯৬২ সালের ১০ জুন। সেই হিসাবে, তিনি ৩১ বছর বয়সে এসএসসি পাস করেছেন। এমনকি এইচএসসি পাস করতে সময় লেগেছে ৩৩ বছর।
অভিযোগের বিষয়ে যা বললেন হারুন সব অভিযোগই তিনি অস্বীকার করেছেন। কালবেলাকে হারুন মজুমদার বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। যে অভিযোগ আছে, সেগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে লেখেন। আমি চোরাচালানচক্রের সঙ্গে যুক্ত কি না, রেলের জায়গা দখল করে খামারবাড়ি করেছি কি না, কারাগারে অস্ত্র নিয়ে গিয়ে কাউকে হুমকি দিয়েছি কি না, আমার অস্ত্রের লাইসেন্স ভুয়া কি না—সব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে লেখেন। আমি এখন ব্যস্ত, কথা বলতে পারব না।’