রাজধানী ঢাকার পর এবার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। দিন যত গড়াচ্ছে, প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে ভীতি। ঘরে-বাইরে কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। সব সময় এক অজানা ভয়। এই বুঝি মশা কামড়াবে। ছোট্ট এ প্রাণীটি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সবাইকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু এখন শুধু রাজধানী নয়, গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতে কীটতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করে
ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হবে। মশক নিধনে জনগণকে যুক্ত করে স্থানীয় সরকারের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাতে হবে। দেশের চিকিৎসকদেরও জাতীয় গাইডলাইন মেনে চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। নয়তো আগামীতে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরও ভীতি সৃষ্টি করবে।
রাজধানীর ডেঙ্গুর হটস্পট এলাকা শনির আখড়ায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি মহল্লায় এখন ডেঙ্গু রোগী। ইকবাল নামে এলাকার এক বাসিন্দা জানান, তার ২৭ বছর বয়সী ছোট ভাই নোমান ডেঙ্গু আক্রান্ত। তিনি রাজধানীর নিউমার্কেটের একটি দোকানে কর্মরত। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে পরিবারের সবার মধ্যে চরম ভীতি সৃষ্টি হয়েছে।
ইকবাল আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু যখন শুরু হয়, তখন থেকেই একটা ভয়ে ছিলাম। মশা দেখলে ভয়ে চমকে উঠি। ছোট ভাই নোমানের ডেঙ্গু হওয়ার পর থেকে এই ভয় আরও বেড়ে গেছে। জানি না কতদিন নিরাপদ থাকতে পারব।
আরেক হটস্পট জুরাইনের বিক্রমপুর প্লাজার পাশ ঘেঁষে যাওয়া সড়কে কিছুদূর গেলে সুমনের চায়ের দোকান। দিনের বেলায়ও মশার কয়েল জ্বলতে দেখা গেল। সেখানে কথা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ড্রাইভার ও এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেনের সঙ্গে। তার ছোট ছেলে পশ্চিম জুরাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। চলতি সপ্তাহ থেকে ছেলেকে স্কুলে যেতে দিচ্ছেন না।
তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের বিল্ডিংয়ে তিনজনের ডেঙ্গু হয়েছে। এর মধ্যে একটা বাচ্চাও আছে। ছেলের জন্য ভয় হচ্ছে। মশায় যাতে কামড়াতে না পারে সে জন্য স্কুলে যেতে দিইনি। ঘরে মশারি টানিয়ে রাখছি।’
ঢাকা থেকে ভীতি এখন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ১৪ জুলাই দুই সন্তানের মা তানিয়া মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ খবরের পর শরীয়তপুরের জাজিরায় ডেঙ্গুভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা হবিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে একটা ভীতি ছিল। কিন্তু সুস্থ মানুষ তানিয়ার মৃত্যুতে আমাদের মধ্যে চরম ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। মশার আতঙ্কে ঠিকমতো ঘুমও হচ্ছে না।
চট্টগ্রামে শনাক্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড: চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, দিন যত যাচ্ছে চট্টগ্রামে ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। মাত্র আট দিনের মাথায় ফের সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে বন্দরনগরীতে। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ ও নিয়ন্ত্রণ শাখা) ডা. মোহাম্মদ নুরুল হায়দার কালবেলাকে জানান, গতকাল বুধবার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ১১৮ জনের, যা এ পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৯ জুলাই সর্বোচ্চ ১১১ আক্রান্ত শনাক্তের রেকর্ড হয়েছিল। চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জন। ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর (বছরের প্রথম সাত মাস) বিবেচনায় মৃত্যুর এ সংখ্যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২০ সালে চট্টগ্রামে ১৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছিল। ওই বছর ডেঙ্গুতে কেউ মারা যায়নি। ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয় ২৭১ জনের। মৃত্যু হয় ৫ জনের। ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয় ৫ হাজার ৪৪৫ জনের। মৃত্যু হয় ৪১ জনের। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু হলেও ওই বছর জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ২০২২ সালে ডেঙ্গু মৌসুমের শেষদিকে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এতে ৪১ জনের মৃত্যুর রেকর্ড হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের শুরুতেই (জানুয়ারিতে) প্রাণ হারান ৩ জন। এরপর মে মাসে ৬ জন এবং জুলাই মাসে ১১ জনসহ মোট ২০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত সাত মাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ জনে।
চিকিৎসকরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত মে-জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে ডেঙ্গু মৌসুমের শেষদিকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়; কিন্তু এবার শুরু থেকেই আগ্রাসী রূপে বেড়ে চলেছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণেই এমনটা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি কালবেলাকে বলেন, এবারের রোগীদের অবস্থা খুবই জটিল। খারাপ অবস্থা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন তারা। এবার অন্য বছরের তুলনায় শনাক্তের হারও বেশি। তাই দিনের বেলায় মশারি টানানো, মশার কয়েল ব্যবহারের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকায় ভর্তি হতে না পেরে শেরপুর ও হবিগঞ্জের রোগীরা: শেরপুর প্রতিনিধি জানান, ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে সিট না পেয়ে শেরপুর ফিরে গেছেন মাহফুজা বেগম। তিনি বলেন, ‘ঢাকার হাসপাতালে কোনো সিট না পেয়ে এলাকায় চলে এসেছি। এখানে ভর্তি হওয়ার পর এখন মোটামুটি সুস্থ আছি।’
শেরপুরের বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা হীরণ দেবও বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বরসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। পরে ডেঙ্গু পরীক্ষায় রোগটি শনাক্ত হয়। এখন তিনি সদর হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত ১৫ দিনে শেরপুর জেলা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৩৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গতকাল ভর্তি হয়েছেন ৫ জন। ডেঙ্গু জ্বর বাড়লেও শেরপুর পৌরসভায় এখন পর্যন্ত বড় ধরনের প্রচারণা ও মশা নিধনের কার্যক্রম লক্ষ করা যায়নি।
শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্য বলেন, ‘রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সবাই ঢাকা থেকে এসেছেন বলেও জানান তিনি।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ঢাকা থেকে এসেছেন। এ পর্যন্ত সেখানে ৪৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর ৩ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সুস্থ হয়েছেন ২৮ জন। আরও ১২ জন বর্তমানে চিকিৎসাধীন। এ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য একটি আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আমিনুল ইসলাম সরকার জানান, আক্রান্ত অনেক রোগীই ঢাকা থেকে এসেছেন। তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। রোগীদের পরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় কিট রয়েছে।’
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় ডেঙ্গু আতঙ্ক প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রাসেল জানান, শরীরে জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিলে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এর পর থেকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, জেলায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ২৯৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৭১ জন রোগী। এর মধ্যে ৩১ জন গতকাল বুধবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৩১ জন।
পিরোজপুরের সিভিল সার্জন ডা. হাসনাত ইউসুফ জাকি জানান, জেলার নেছারাবাদে সবচেয়ে বেশি ৩৪ জন এবং জেলা সদর হাসপাতালে ১০ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া মঠবাড়িয়া উপজেলায় ১১ জন, ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় ১০ জন নাজিরপুর উপজেলায় ৫ রোগী চিকিৎসাধীন।
মন্তব্য করুন