চূড়ান্ত সাফল্য না এলেও জাতীয় নির্বাচনের আগের সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে না বিএনপি। হামলা-মামলা, নির্যাতনসহ সরকারের নানা ‘অপকৌশলের’ সঙ্গে পেরে না ওঠায় লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করে দলটি। তবে জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ায় আন্দোলনের নৈতিক বিজয় হয়েছে বলেও তারা মনে করে। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে বিগত আন্দোলনের এমন মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি মনে করে, আন্দোলন ঘিরে তাদের পরিকল্পনায় কোনো ঘাটতি ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো। তবে সরকার বিচার বিভাগ, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সেই আন্দোলন দমাতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। হামলা-মামলা, নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। নিজেরা সহিংসতা করে তার দায় বিএনপির ওপর চাপিয়েছে। সরকারের এসব ‘অপকৌশলের’ সঙ্গে তারা ঠিকভাবে পেরে ওঠেনি।
দলটির দাবি, আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল। তাদের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ৭ জানুয়ারির ভোট বয়কট করেছে। প্রকৃতপক্ষে ওই নির্বাচনে ৫-১০ শতাংশ ভোট পড়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা বাড়িয়ে ৪১.৮ শতাংশ দেখিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয় এবং বিএনপির নৈতিক বিজয় হয়েছে।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, বিগত আন্দোলন ঘিরে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা মাথায় রেখেই তারা আগামী দিনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করবেন। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনের দিকে অগ্রসর হবেন।
জানা গেছে, নির্বাচনের পর আন্দোলনের লক্ষ্যে আবার নিজেদের গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছে বিএনপি। একই সঙ্গে যুগপতের শরিকদেরও রাজপথে সক্রিয় করতে চাইছে। কিন্তু নির্বাচনের পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও যুগপতভাবে কোনো কর্মসূচি মাঠে গড়ায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলনের কর্মকৌশল নির্ধারণে পরামর্শ নিতে গত রোববার থেকে মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর এ ধরনের বৈঠক এবারই প্রথম। প্রথম দিন ১২ দলীয় জোট ও এলডিপি, পরদিন সোমবার জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লেবার পার্টি, মঙ্গলবার গণঅধিকার পরিষদ (নুর) ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য এবং গতকাল বুধবার গণফোরাম-বিপিপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলগুলো দীর্ঘ সময় সংগ্রাম করছে। নতুন করে আন্দোলন ও কর্মসূচি নির্ধারণের জন্য তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করছেন।
জানা গেছে, বিএনপির আগ্রহে যুগপতের মিত্ররা এখন নতুন কর্মসূচির প্রস্তাব তৈরি করছে। শরিকদের মতামত ও প্রস্তাবগুলো স্থায়ী কমিটিতে পর্যালোচনার মাধ্যমে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন করবে বিএনপি। এর পরই মাঠে গড়াবে যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি।
জানা গেছে, গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ও পরবর্তী আন্দোলন ঘিরে বিএনপির পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল বলে মনে করে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অধিকাংশ দল। বৈঠকে এসব দলের নেতারা বলেন, ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ সফল করতে বিকল্প পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেদিন তেমন কিছু দেখা যায়নি। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপকৌশলের কাছে হার মানতে হয়েছে। এর ফলে ওইদিন থেকেই সম্ভাবনাময় যুগপৎ আন্দোলনও ব্যাকফুটে চলে যায়। তাই আগামীর আন্দোলন সফল করতে এখন থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
বিএনপিকে সাংগঠনিক শক্তি বিবেচনায় আগামীর আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীকে একমঞ্চে আনার পরামর্শ দেয় ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। তারা বলেন, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বাম-ডান ও ইসলামী ঘরানার দলগুলো অর্থাৎ বিগত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের বাইরে আন্দোলনে থাকা সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামতে হবে। তবে কোনো কারণে ‘একমঞ্চ’ সম্ভব না হলে সবাইকে সম্পৃক্ত করে যুগপতের পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ তাদের। দাবি এক ও অভিন্ন হওয়ায় জামায়াতসহ সরকারবিরোধী সবাইকে নিয়ে যুগপতের সম্প্রসারণের প্রস্তাব দিয়েছে নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদ।
গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের এক নেতা বৈঠকে জামায়াতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে জোটের আরেক নেতা বলেন, এ বিষয়ে অনেক আগেই বিএনপির সঙ্গে তাদের চূড়ান্ত বোঝাপড়া আছে। ফলে বৈঠকে এই ইস্যুতে আলোচনা আর অগ্রসর হয়নি।
জানা যায়, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চাওয়ায় জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চ এবং যুগপৎ আন্দোলনে চরম আপত্তি রয়েছে বামঐক্যের।
এদিকে বিএনপিকে নেতাকর্মীদের ‘মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহার ও কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী দিনের কর্মসূচি প্রণয়নের পরামর্শ দেয় সমমনা জোট। গণতান্ত্রিক বামঐক্য সরকারের গণবিরোধী যে কোনো ইস্যুতে সোচ্চার হওয়া ও কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব করে।
বিএনপি গত রোববার সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা যাতে রাজনীতি করতে না পারেন, সেজন্য তাদের সাজা দিয়ে দূরে রাখতে নতুন ট্রাইব্যুনাল করছে সরকার। বামঐক্যের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়টি উত্থাপন করে বিএনপি। তখন জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়, সব স্বৈরশাসকই এভাবে দমনপীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চায়। এসব মোকাবিলা করেই আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। এদিকে সমমনা জোট আগামীতে কর্মসূচি প্রণয়নে সমন্বয়হীনতা দূরীকরণের ওপর জোর দেয়। যুগপতের সব দল ও জোট থেকে দু-একজন করে নিয়ে একটি শক্তিশালী লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন তারা।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘সরকারের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ মানুষ পরিবর্তন চায়। এ অবস্থায় যুগপৎ আন্দোলনকে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত করে মাঠে নামা যায়, সে বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছি। আগামীতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় করা হবে।’
১২ দলীয় জোটের শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন ফারুক রহমান বলেন, ‘আগামীর আন্দোলনে জামায়াতসহ সরকারবিরোধী সব দলকে কীভাবে একসঙ্গে মাঠে নামানো যায়, সেই আন্দোলনের কর্মকৌশল কী হবে—সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ঈদের পর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে।’