আগামী এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা বাড়াতে চায় সরকার। আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের জন্য চলতি বাজারমূল্য জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে নতুন বাজেট উত্থাপনের পাশাপাশি জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করবেন।
মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি হলো এক বছরে দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে উৎপাদিত সব রকম পণ্য ও সেবার অর্থমূল্যের যোগফল। আর এক অর্থবছর তুলনায় পরের অর্থবছরে পণ্য ও সেবার উৎপাদন যতটুকু বাড়ে, সেটিই জিডিপি প্রবৃদ্ধি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে চলতি বাজারমূল্যে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এর আকার ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা বাড়বে বলে ধরা হচ্ছে। অর্থাৎ চলতি বাজারমূল্যে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির শক্তি বা সামর্থ্য মূল্যায়ন এবং সেই অনুযায়ী বছরভেদে অর্থনীতির কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা জানতেই প্রতিবছর বাজেটের মাধ্যমে চলতি বাজারমূল্যে এবং স্থির মূল্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বাজেট ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব পরিকল্পনাসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জিডিপির আকার প্রাক্কলন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় জিডিপির বিশাল লক্ষ্য নির্ধারণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাজেটীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনুকূল নীতি পদক্ষেপ কার্যকরের মাধ্যমে সরকার এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, এই বর্ধিত প্রাক্কলনের মূল চালিকাশক্তি হবে দেশের শক্তিশালী ভৌত অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় সংস্কার, তথ্যের অবাধ প্রবাহের নিশ্চয়তা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে দক্ষতা উন্নয়ন। এ লক্ষ্যে সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করবে। সেখানে একটি বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী, রপ্তানি বাজারের ক্রমাগত সম্প্রসারণ, প্রবাসী আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি এবং সামষ্টিক ও সামাজিক খাতের অর্জনের ধারাবাহিকতা বাড়তি জিডিপির আকার প্রাক্কলনে উৎসাহ জুগিয়েছে।
তবে জিডিপির এই লক্ষ্যমাত্রাকে অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির পরিমাপ বুঝতেই বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের আকার নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে অর্থনীতিতে যে ধরনের চাপ রয়েছে, সেই অবস্থায় এত বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ মোটেও সময়োচিত হয়নি। এই লক্ষ্যে পৌঁছানো খুবই কঠিন হবে। কারণ এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ৬ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এর জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন, যে পরিমাণ রপ্তানি বৃদ্ধি দরকার এবং যে হারে ভোক্তার ব্যয় বৃদ্ধি দরকার, সেই পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে এখন নেই। উল্টো দেখছি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তার ব্যয়ের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে মানুষের ভোগব্যয় কমে গেছে। ডলারের অপর্যাপ্ততা এবং দাম অস্বাভাকি বৃদ্ধি ও আর্থিক খাতের দুরবস্থার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানিকারকদের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাস্তবতায় জিডিপির আকার এত বেশি কীভাবে বাড়বে, সেটি বোধগম্য নয়।’
দেশে জিডিপি নির্ধারণে ১৯টি খাতে উৎপাদিত সবরকম পণ্য ও সেবার বাজার মূল্যকে জিডিপির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খাতগুলো হলো কৃষি (কৃষি, বনজ ও মৎস্য); খনিজ ও খনন, শিল্প ম্যানুফ্যাকচারিং (বৃহৎ, ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প); বিদ্যুৎ, গ্যাস, বাষ্প ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ; পানি সরবরাহ পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহার; নির্মাণ; সেবা (পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, যানবাহন ও মোটরসাইকেল মেরামত; পরিবহন ও সংরক্ষণ-স্থলপথ, পানিপথ, আকাশপথ, সংরক্ষণ ও সহায়ক সেবা, ডাক ও কুরিয়ার যোগাযোগ; আবাসন এবং খাদ্য পরিবেশন কার্যক্রম; তথ্য ও যোগাযোগ; আর্থিক এবং বীমা কার্যক্রম; রিয়েল এস্টেট কার্যক্রম; পেশাদার বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত কার্যক্রম; প্রশাসনিক ও সহায়তামূলক পরিষেবা কার্যক্রম; জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা এবং বাধ্যতামূলক সামাজিক নিরাপত্তা; শিক্ষা; মানব স্বাস্থ্য এবং সামাজিকসেবা কার্যক্রম; শিল্পকলা ও বিনোদন এবং অন্যান্য।