ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন মূল কিলার আমানুল্লাহ। এমনকি নিজের আসল নাম-পরিচয় গোপন করেছিলেন এক সময়ে সক্রিয় এই চরমপন্থি নেতা। আসল নাম শিমুল ভূঁইয়া হলেও তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট নিয়েছেন আমানুল্লাহ নামে। আরেক চরমপন্থি সন্ত্রাসী আমানুল্লাহ তারই (শিমুল) শিষ্য বলে জানা গেছে। ২০১৯ সালে ঢাকা থেকে শিষ্যের নামেই এনআইডি ও পাসপোর্ট নেন এক সময়ে খুলনার শীর্ষ চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া।
১৩ মে কলকাতায় এমপি আনারকে নৃশংসভাবে হত্যার দুদিন পর দেশে চলে আসেন আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। ঢাকার মোহাম্মদপুরে বোনের বাসায় ওঠেন। সেখান থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তাকে জালে নিয়ে জেরা শুরু করে। এরপরই স্বীকার করেন এমপি আনারকে তার নেতৃত্বেই খুন করা হয়েছে। এই খুনের মাস্টারমাইন্ড এমপির বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন।
কিলার আমানুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্ট ডিবি সূত্র জানায়, আমানুল্লাহ একেকবার একেক কথা বলে গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিয়ে বিভ্রান্ত করা ছাড়াও নিজের পরিচয় নিয়েও মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। নিজেকে আমানুল্লাহ বলে পরিচয় দিলেও তার আসল নাম শিমুল ভূঁইয়া। তিনি খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী এবং চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এমপি আনারকে হত্যার বিষয়েও আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছেন। কখনো বলছেন মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, কখনো বলছেন চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অজ্ঞান করে পরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবার কখনো বলছেন, খুনের সময় তিনি (শিমুল) ফ্ল্যাটের ওপরে ছিলেন। কী কারণে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, সে বিষয়ে বারবার জিজ্ঞেস করলেও তিনি কোনো কারণ দেখাচ্ছেন না। শুধু বলছেন, সব জানেন শাহীন। তাকে শুধু বলা হয়েছে হত্যার জন্য, তাই তিনি হত্যা করেছেন।
ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, এই হত্যার সঙ্গে আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল এবং অন্য যারা জড়িত তারা ভাবতে পারেননি যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পেয়ে যাবে। তারা ভেবেছিলেন, হত্যার পর লাশ গুম করে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করবেন যে, কেউ কোনোদিন মরদেহও খুঁজে পাবে না এবং কী কারণে এই খুন হয়েছে, তা কেউ জানতেও পারবে না। এজন্য খুন করার পর তারা আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এসেও তারা এ বিষয়ে ভাবনাহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন।
ডিবি ও খুলনার স্থানীয় সূত্র জানায়, এমপি আনার হত্যার এ ঘটনায় আমানুল্লাহ ওরফে শিমুলের গ্রেপ্তারের পর বের হয় তার আসল পরিচয়। তিনি খুলনার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক এবং সাধারণ মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম। তার স্ত্রী ও ভাই প্রকাশ্য রাজনীতিতে রয়েছেন। স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তা খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য। তবে পুলিশের খাতায় হত্যা মামলার আসামি। ছোট ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিপলু দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
খুলনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতার আগে থেকেই নকশাল বাহিনীর সঙ্গে সখ্যের কারণে পারিবারিকভাবে শিমুল ভূঁইয়ার পরিবার ছিল দস্যু প্রকৃতির। আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। সে সময় স্থানীয় ডুমুরিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান ইমরানকে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। রাজশাহীতে থাকাকালে ১৯৯১ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে সাত বছর কারাভোগ করে। ২০০০ সালে যশোরের অভয়নগরে অন্য একটি হত্যা মামলায় ১৩ বছর পর্যন্ত জেল খাটে শিমুল ভূঁইয়া। এ ছাড়া তার নামে অসংখ্য হত্যা মামলা রয়েছে।
ঝিনাইদহের এক প্রবীণ রাজনীতিবিদ জানান, এমন কোনো অপরাধ নেই, যেটা শিমুল ভূঁইয়া করেনি। হত্যা, জমি দখল, সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ, মাদক ও অস্ত্রের অবৈধ কারবার, স্বর্ণের চোরাচালানের কারবারসহ সব অপরাধের সঙ্গে জড়িত তিনি। তার নামে এখনো এলাকায় আতঙ্ক দেখা দেয়। তার উপজেলার রাজনীতি তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন। সেখানে অন্যরা ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না।
জানা যায়, শিমুল তার চেয়ারম্যান ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়ার মাধ্যমে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম পাল্টে ভুয়া নামে পাসপোর্ট তৈরি করে।
শিমুলের বিষয়ে জানতে তার স্ত্রী মুক্তা ও ভাই শিপলুকে বারবার ফোন দেওয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠালেও তারা সাড়া দেননি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আনার হত্যায় মূল কিলার বা সংঘটক হলেন আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। যিনি নিজের পরিচয় গোপন করেছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা। তার নামে অনেকগুলো হত্যা মামলা রয়েছে।