আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি কিংবা কোম্পানি করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে ভিন্ন কথা। সংস্থাটির ভাষ্য, এনবিআর সুযোগ দিলেও তারা তাদের কাজ অব্যাহত রাখবে।
এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে, বাজেটে দেওয়া বিতর্কিত এই সুযোগ কতটা কাজে আসবে অর্থনীতিতে? এ ছাড়া এনবিআর অপ্রদর্শিত এবং অবৈধ অর্থ কীভাবে চিহ্নিত করবে, তা নিয়েও অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, আয়কর আইন ২০২৩ বা অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তির কোনো পরিসম্পদ অর্জনের উৎসের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। যদি সেই ব্যক্তি ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বা ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন বা সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করেন। এক্ষেত্রে ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য বিভিন্ন এলাকার মৌজা ভেদে স্থাপনা, বাড়ি, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেসের করহার সর্বনিম্ন প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত রাখা হয়েছে।
একই সঙ্গে ভূমির করহার বিভিন্ন এলাকার মৌজা ভেদে প্রতি বর্গমিটারে সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া শেয়ার ও অন্যান্য সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে জমা অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট এবং সব ধরনের ডিপোজিট বা সেভিং ডিপোজিটের জন্য মোট পরিসম্পদের ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। এতে এসব আয় বৈধ হয়ে যাবে।
তবে নতুন নিয়মে আরও বলা হয়েছে, কোনো করদাতার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রম চলমান থাকলে, তিনি এই সুযোগ নিতে পারবেন না। অর্থাৎ ফৌজদারি মামলা চলমান থাকলে তিনি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পাবেন না। এ ছাড়া আয়কর কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির আর্থিক বিষয় অনুসন্ধানের স্বার্থে ব্যাংক হিসাব জব্দ করলে তিনিও এ সুযোগ নিতে পারবেন না।
বিষয়টি সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনটা অবৈধ অর্থ আর কোনটা অপ্রদর্শিত অর্থ তা শনাক্ত করার সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া এনবিআর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেও ছাড় দিচ্ছে না দুদক। সংস্থাটি বলছে, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের অনুসন্ধান করা দুদকের কাজ। এই কার্যক্রম চলমান থাকবে।
দুদকের সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান এনবিআরের দেওয়া একটা সুযোগ। প্রায় প্রতিটি বাজেটে এ ধরনের সুযোগ দিয়ে আসছে এনবিআর। কেউ যদি সুযোগ নেয়, তাহলে এনবিআরের কাছ থেকে রিলিজ পাবে। কিন্তু এটা যদি মানি লন্ডারিং কিংবা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ হয়ে থাকে, অবশ্যই সেটা দুদক দেখতে পারবে।’
ফলে দুদক নমনীয় না হলে এনবিআরের দেওয়া সুযোগ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যদিও আয়কর কর্মকর্তারা বলছেন, ‘আয়কর আইন সংসদে পাস হওয়া আইন। এই আইনে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা কার্যকর থাকবে।’
এদিকে কালো টাকা সাদা করার বির্তকিত এ সুযোগ দেশজুড়ে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে টিআইবিসহ সব সংস্থা এর সমালোচনা করছে।
গতকাল সোমবার সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের এক আলোচনা সভায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাজেটে সৎ করদাতাদের জন্য ৩০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। আর কালো টাকার জন্য ১৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়েছে।’
কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিষয়ে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে, কয়েকজন ব্যবসায়ী অডিট সংক্রান্ত সমস্যার কারণে তাদের সব সম্পদ প্রদর্শন করতে পারেননি। সেজন্য আমরা এ প্রস্তাব দিয়েছি। সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা হবে এবং সংসদ সদস্যরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
তিনি বলেন, ‘অপ্রদর্শিত অর্থ দেশেই থাকে। আর অর্থ পাচার ভিন্ন বিষয়। পাচারের অর্থ বিভিন্ন ভোগ-বিলাসে ব্যয় হয়। তাই আমরা সুযোগ দিয়েছি অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ। এটা অনেক ক্ষেত্রে জমি বা ফ্ল্যাট
ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তৈরি হয়ে থাকে। এ ছাড়া রিটার্নে অনেকে তার অর্থ প্রদর্শন করতে পারেননি বা না জেনে করেননি, এ সুযোগ তাদের জন্যই দেওয়া হয়েছে।’