সম্প্রতি সরকারি সাবেক ও বর্তমান অনেক কর্মকর্তার দুর্নীতি প্রকাশ পাওয়ায় এ নিয়ে সংসদেও তুমুল আলোচনা হয়েছে। দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও দাবি উঠেছে। গতকাল সোমবার সংসদের প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা বলেছেন, দেশে দুর্নীতির মচ্ছব চলছে। এখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিল সমাধি হবে। সরকারে বিভিন্ন জায়গায় রাসেলস (দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি) ভাইপার আছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, নিষ্ঠুর অলিগার্করা দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই অলিগার্কের স্বার্থ রক্ষার্থে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে লুট ও নৈরাজ্য, খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত করেছে। এর থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার, জন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল বর্তমান সময়ের জরুরি কর্তব্য। কিন্তু সেই লক্ষ্যে বাজেটে
কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহারের কথা বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজেট প্রস্তাবনা তার থেকে যোজন যোজন দূরে।
তিনি বলেন, বিএনপি আমলের দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে আমাদের সেই কলঙ্ক দূর হলেও ওই সূচকে বাংলাদেশ এখনো শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে; বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির সাম্প্রতিক যে চিত্র বেরিয়ে আসছে, তা দেশের ভাবমূর্তি শুধু নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা সৃষ্টি করছে।
মেনন বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাবেক পুলিশপ্রধান (বেনজীর আহমেদ) ও সাবেক সেনাপ্রধানের (আজিজ আহমেদ) দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র উপরিভাগ মাত্র। এখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিল সমাধি হবে।
সরকারের উদ্দেশে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক এ নেতা বলেন, দুর্নীতির এই মচ্ছব বন্ধ করতে এখনই বিশেষ কমিশন গঠন করুন, দুর্নীতিবাজদের অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত, বিচার করে কঠিনতম শাস্তি দিন। ঋণখেলাপি ও অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন।
কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বলেন, উন্নয়নের পথে বাধা হচ্ছে মাদক, দুর্নীতি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার। শুধু কমান্ড দিয়ে, দুর্নীতি দমন কমিশন দিয়ে দুর্নীতি কমানো যাবে না। এজন্য মহা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্তে মানুষের মনের আতঙ্ক দূর করতে বিজিবি, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন, স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে আরও জোরদার করার দাবি জানান সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ কক্সবাজার সীমান্ত থেকে একটু দূরে। সমগ্র জাতি ও বিশ্ব সেন্টমার্টিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা আশা করি, এ নিয়ে সংসদে কেউ না কেউ কিছু বলবেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষের আতঙ্ক দূর করবেন।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম মামলা জট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। এজন্য তিনি নতুন বিচারক নিয়োগ, উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারকদের বেতনভাতা বাড়ানো, বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার দাবি জানান। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ শক্তিশালী হলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হবে।
ঝিনাইদহ-৩ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সালাহ উদ্দিন মিয়াজী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা সীমান্তবর্তী এলাকা। তারকাঁটাবিহীন প্রায় ১৭ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান, নারী-শিশু পাচার ও মাদকদ্রব্যের চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনীকে সমন্বয় করে একটি স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাব।
দুর্নীতিবাজদের রাসেলস ভাইপার সাপের সঙ্গে তুলনা করে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, রাসেলস ভাইপার সাপ এই সরকারে চলে আসছে। যখন সাপ আসে প্রকৃতিতে বেজি থাকে। এই বেজি সাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই সরকারে বিভিন্ন জায়গায় রাসেলস ভাইপার আছে; কিন্তু বেজি ওই পরিমাণ নেই যে, সাপ ধরবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। একজন ভদ্রলোককে (দুর্নীতিবাজ) দুদক ধরতে পারেনি, এনবিআর ধরতে পারেনি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট ধরতে পারেনি। আর এনবিআরের মতিউর রহমানকে ধরল একটা ছাগল। ছাগল না এলে এই লোককে আর জানতে পারতেন না।
বেনজীরের বিষয়ে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। তিনি কত বড় হয়ে গেলেন মন্ত্রণালয় জানল না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানলেন না। এই বাচ্চাটা এত বড় হয়ে গেল, আর কিছুদিন সুযোগ পেলে পুরো গোপালগঞ্জ কিনে ফেলতেন। তার পরও বলব, এর দায় এই মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।
তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করবেন অসুবিধা নেই। কিন্তু এই সাদা করার মধ্য দিয়ে বেনজীর আর মতিউরের টাকা সাদা হয়ে যায়, আর এদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও আদর্শের উত্তরাধিকারদের টাকা সাদা হয়ে যায়, তাহলে এই দেশে…।