হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পিআর পদ্ধতি সম্ভাবনা না সংকট

পিআর পদ্ধতি সম্ভাবনা না সংকট

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন। তবে অনেক সময় ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট বা এফপিটিপি’ নামে প্রচলিত ভোট পদ্ধতিতে তার সঠিক মূল্যায়ন দেখা যায় না। এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশ গ্রহণ করেছে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন-পিআর)। ঠিক এই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির অন্যতম আলোচিত বিষয়। সারা দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যখন নানা আলোচনা চলছে, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে—ঠিক তখনই এ নিয়ে ব্যাপক চর্চা চলছে। আসলে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কী, ইতিহাস, এর সুবিধা বা অসুবিধা কী, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়ার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কেমন, উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি ভালো কি না, এফটিপিটির বিকল্প হিসেবে পিআর কতটা বাস্তবসম্মত—এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির

পিআর পদ্ধতি কী

পিআর হলো এমন এক নির্বাচনী পদ্ধতি, যেখানে একটি দল বা প্রার্থী যে পরিমাণ ভোট পান, সে অনুপাতে সংসদ বা আইনসভায় আসন পান। এ পদ্ধতির মূল ধারণা, ‘ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন’, মানে ২০ শতাংশ ভোট পেলে দলটি ২০ শতাংশ আসন পাবে, তা সে একটি আসনেও সরাসরি বিজয়ী হোক বা না হোক। এ পদ্ধতিতে সাধারণত মাল্টি-মেম্বার কনস্টিটুয়েন্সি ও দলভিত্তিক ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইতিহাস

পিআরের ধারণার উদ্ভব হয় ১৮৩০-এর দশকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে, যখন সমাজে ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব না পাওয়ার বিরুদ্ধে এক ধরনের আন্দোলন শুরু হয়। তবে আধুনিকভাবে প্রথমবারের মতো পিআর পদ্ধতি চালু হয় বেলজিয়ামে ১৮৯৯ সালে। পরে এটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা ছিল জরুরি।

কোন কোন দেশে পিআর আছে

বর্তমান বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ দেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। উন্নত দেশের সংগঠন ওইসিডির ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, তথা প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ এ পদ্ধতি অনুসরণ করে। পিআর পদ্ধতি বর্তমানে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, ইসরায়েল, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, নেপাল প্রভৃতি দেশে চালু রয়েছে। তবে একেক দেশ একে একেকভাবে বাস্তবায়ন করে মিশ্র, উন্মুক্ত তালিকা, বদ্ধ তালিকা অথবা জার্মানির মতো এমএমপি বা মিশ্র পিআর ও সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতিতে।

বৈশিষ্ট্য

পিআর পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো—ভোটের হার অনুযায়ী আসন বণ্টন হয়, মাল্টি-মেম্বার কনস্টিটুয়েন্সি থাকে, দলভিত্তিক তালিকা ভোটাররা বেছে নেয়, ছোট দলগুলোও সুযোগ পায় সংসদে প্রবেশের। তবে ভোটার ও প্রার্থীর সরাসরি সম্পর্ক তুলনামূলক দুর্বল হয়।

ধরন

পিআর পদ্ধতি সাধারণত তিন ধরনের হয়। মুক্ত তালিকা পদ্ধতি—দলগুলো ভোটের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের মধ্যে থেকে আসন পায়। বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি—দল ঠিক করে দেয় কে হবেন সংসদ সদস্য। মিশ্র পদ্ধতি—কিছু আসনে প্রতীকভিত্তিক, কিছু আসনে পিআর ভিত্তিতে নির্বাচন হয়।

সুবিধা

পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—ভোটের প্রতিফলন নিশ্চিত হয়, কোনো ভোট ‘নষ্ট’ হয় না। সংখ্যালঘু, ধর্মীয় বা আঞ্চলিক দলগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ কমে, আলোচনা ও সমঝোতাভিত্তিক শাসন হয়। রাজনৈতিক বৈচিত্র্য উঠে আসে, একক দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ কমে যায়। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নির্বাচন সহজ হয়।

চ্যালেঞ্জ

প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—দুর্বল ও জটিল জোট সরকার গঠিত হয়, যা কার্যকারিতা কমায়। নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়, কখনো কখনো সিদ্ধান্তই হয় না। উগ্র, বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সংকীর্ণ গোষ্ঠীও বৈধতা পেয়ে যেত সংসদে, যার রাষ্ট্রের ঐক্য প্রশ্নের মুখে পড়ে। নেতা ও জনতার সরাসরি সম্পর্ক থাকে না, দলই সব সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, ঘনঘন সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা প্রবল থাকে।

বড় দল চায় না, ছোট দল চায় কেন

বড় দলগুলোর পিআর পদ্ধতি না চাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, তারা এফপিটিপিতে কম ভোট পেয়েও অনেক আসন পায়। পিআর চালু হলে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। অন্যদিকে, ছোট দলগুলো পিআর চায় কারণ, পিআর পদ্ধতিতে তাদের মতামতের প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত হয়, এমনকি ৫ থেকে ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পাওয়ার সুযোগ থাকে এ পদ্ধতিতে। এতে তারা ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠতে পারে, জোট সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

উন্নয়নশীল দেশের জন্য কেমন

উন্নয়নশীল দেশ সাধারণত একটি একক ও কেন্দ্রিক রাষ্ট্র হয়ে থাকে, যেখানে সমাজ কাঠামো তুলনামূলকভাবে অভিন্ন। এতে পিআর পদ্ধতি আঞ্চলিকতা, ধর্মীয় মেরূকরণ ও বিদেশি প্রভাবিত গোষ্ঠীর উত্থান ঘটাতে পারে। এর ফলে রাজনীতিতে দলীয় শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন কাঠামোগত দুর্বলতায় জর্জরিত হতে পারে।

তবে পিআর পদ্ধতি নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির একটি সম্ভাব্য পথ। যদিও এর সাফল্য নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক সাংবিধানিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার ওপর।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কুষ্টিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ভোমরারা হতাশ হয়েছেন : নুর

দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা

এবার চট্টগ্রামে সাংবাদিককে গলা টিপে হত্যাচেষ্টা

সাবেক ৩ গভর্নর ও ৬ ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব

এনসিপির হয়ে নির্বাচন করব কিনা সিদ্ধান্ত নেইনি : আসিফ মাহমুদ

সবাইকে টেস্ট খেলানো জরুরি নয় : জোরাজুরিতে দেউলিয়ার শঙ্কা

প্রবাসেও আপ বাংলাদেশের কমিটি ঘোষণা 

ইসরায়েল পুড়ছে রেকর্ড তাপমাত্রায়

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে আর্থিক সহায়তার চেক দিল যমুনা অয়েল

১০

অসহায় পরিবারের দুই শিশুকে চিকিৎসা সহায়তা-অটোরিকশা দিলেন তারেক রহমান

১১

৩০০ আসনে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে গণতন্ত্র মঞ্চ 

১২

ড্রোন শো পরিচালনার প্রশিক্ষণে চীন যাচ্ছেন ১১ জন

১৩

সামাজিক কাজে অবদান রাখায় নিবন্ধন পেল প্রভাত

১৪

স্বাস্থ্যের ডিজির আশ্বাসে মন গলেনি, নতুন কর্মসূচি ছাত্র-জনতার

১৫

শহীদ মিনারে কাফনের কাপড় পরে বস্তিবাসীদের অবস্থান

১৬

পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে : চরমোনাইর পীর

১৭

চট্টগ্রামে ১০ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা মেয়রের

১৮

রাজধানীতে জামায়াতের বিক্ষোভ-সমাবেশ

১৯

গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগের প্রতিবাদ সম্পাদক পরিষদের

২০
X