চীন, পাকিস্তান, ভারত যখন অতিভারী বর্ষণ আর বন্যায় নাকাল, তখন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় বইছে তাপপ্রবাহ। ইউরোপ আমেরিকা জ্বলছে দাবানলে, খরায় পুড়ছে সোমালিয়া, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়েসহ পুরো আফ্রিকা। দ্রুত গলছে গ্রিনল্যান্ড আর অ্যান্টার্কটিকার বরফ। গলে যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে হিমবাহগুলো। এমন চরম আবহাওয়ার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের চরম আবহাওয়ার নিদর্শন ঘনঘন দেখা যাচ্ছে, দুর্যোগগুলো হয়ে উঠছে তীব্র থেকে আরও তীব্র, পূর্বানুমান করা কঠিন হয়ে পড়ছে। চরম আবহাওয়ার এমন রোষে পড়ে এশিয়ায় কয়েক সপ্তাহেই পাঁচশর বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সাম্প্রতিক দুর্যোগ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলছে, এশিয়াতেই যেমনটা দেখা যাচ্ছে, মহাদেশটি বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ গতিতে উষ্ণ হয়ে উঠছে। গত তিন দশকে বন্যা থেকে শুরু করে তাপপ্রবাহ, খরাসহ চরম আবহাওয়াজনিত কারণে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এ অঞ্চলের অন্তত ২ লাখ কোটি ডলার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বার্ষিক ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে।
রেকর্ড তাপ
জাপান মঙ্গলবার তাদের সবচেয়ে উষ্ণ দিন রেকর্ড করেছে; সেদিন গামা অঞ্চলের ইসেসাকি শহরে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। চলতি বছর তারা তাদের রেকর্ডকৃত ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ জুন ও জুলাইয়েরও সাক্ষী হয়েছে। মধ্য-জুন থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত কেবল হিটস্ট্রোকেই ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, টোকিওর চিকিৎসা পরিদর্শকের কার্যালয় কয়েকদিন আগে এমনটাই বলেছে।
অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে কোথাও কোথাও রেললাইন বাঁকা বা বিকৃত হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ কিছু ট্রেনের চলাচল স্থগিত রেখেছে।
জাপানের এক অফিসকর্মী এএফপিকে বলেন, ‘আমি বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন, কিন্তু যখন আমার দৈনন্দিন জীবনের কথা আসে, আমি এয়ার কন্ডিশনার না চালিয়ে থাকতে পারি না। আমি সত্যিই জানি না কী করা উচিত, প্রতিদিনই মরিয়া হয়ে উঠছি।’
তবে তীব্র এ গরম সামনে কিছুটা কমবে বলেই আশা করা হচ্ছে। জাপানের কিছু কিছু এলাকায় কয়েকদিনের মধ্যে ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা ধারণা দিয়েছেন। ওই বৃষ্টি এবং ঠান্ডা বাতাস তীব্র গরম থেকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দেশটির নাগরিকদের মুক্তি দেবে।
তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে, জুলাইয়ে এমন টানা ২২টি ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাত’ রেকর্ড করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। গত মাসে দেশটির জরুরি পরিষেবা সংস্থাগুলো গরমজনিত অসুস্থতা নিয়ে ফোনও অনেক বেশি পেয়েছে। কর্মীরা যেন আরামে কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিতে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে একাধিক সরকারি সংস্থাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য পোশাক পরিধান নীতিমালা শিথিল করেছে।
তীব্র গরমে সিদ্ধ হয়েছে ভিয়েতনামের অনেক এলাকাও। হ্যানয়ে প্রথমবারের মতো আগস্টের কোনো এক দিনে তাপমাত্রা রেকর্ড ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। নির্মাণশ্রমিক ন্যাম বলেন, গত কয়েকদিন ধরে রাজধানী শহর ‘আগুনে পোড়া তাওয়া’ হয়ে আছে।
তুমুল বৃষ্টি, বন্যা
চীনে একেবারে ভিন্ন চিত্র। সাংহাই থেকে বেইজিং পর্যন্ত দেশটির বিস্তৃত অঞ্চল বন্যার পানিতে ভাসছে, সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি তো হয়েছেই, অনেকে প্রাণও হারিয়েছেন। তুমুল বর্ষণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চীনের দক্ষিণাঞ্চল; আরও বন্যা ও ভূমিধসের আশঙ্কায় গত বুধবার জরুরি পরিষেবার কর্মীরা ওই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জঞ্জাল পরিষ্কারে নেমেছেন।
গুয়াংডং প্রদেশের রাজধানী গুয়াংঝুতে কয়েকশ ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বিত হয়েছে। বন্যায় ভেসে যাওয়া রাস্তা প্রদেশটিতে মশাবাহিত চিকনগুনিয়া ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ানোর আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বছরের এ সময়ে দক্ষিণ চীনে প্রায়ই এমন বন্যা দেখা যায়, তবে এবার, বিশেষ করে গত মাসের একাধিক ঝড় বর্ষণের তীব্রতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
কেবল গত সপ্তাহেই প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে তিনটি ঝড়ের তৎপরতা দেখা গেছে, অথচ জুনের আগে এই ধরনের ক্রান্তীয় ঝড় ছিলই না। গত মাসের শেষদিকে হওয়া বন্যায় রাজধানী বেইজিংয়ের পাহাড়ি জেলাগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একটি বয়স্ক সেবা কেন্দ্রের ৩১ বাসিন্দাসহ কয়েক ডজন মানুষ নিহতও হয়েছে। ভারি বর্ষণ সাধারণত ভূমিধসপ্রবণ পাহাড়ি এলাকা এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে, হঠাৎ বন্যা এসব এলাকার বাসিন্দাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয়।
ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে (সামান্য জায়গায় আচমকা প্রবল বৃষ্টিপাত) সৃষ্ট হঠাৎ বন্যায় শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়েছে।
পাকিস্তানে জুন থেকে বৃষ্টিজনিত ঘণ্টায় শতাধিক শিশুসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বন্যায় শত শত বাড়ি ও ভবন ধ্বংস হয়েছে। দেশটির পাঞ্চাব প্রদেশের অন্তত এক চতুর্থাংশ স্কুল আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা সেইভ দ্য চিলড্রেন। মঙ্গলবার হংকংয়েও সাড়ে তিনশ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে, ১৮৮৪ সালের পর আগস্টে এমন বৃষ্টিবিধৌত দিন আর দেখেনি শহরটি। চীনের এ শহরটিতে বছরে সাধারণত ২ দশমিক ৪ মিটারের মতো বৃষ্টিপাত হয়, যা সিংহভাগই পড়ে গ্রীষ্মকালে, জুন থেকে আগস্টের মধ্যে।
খরা পরিস্থিতি
বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে আফ্রিকার কিছু দেশ যেমন সোমালিয়া, নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়েতে খরার তীব্রতা বেশি। এ ছাড়া, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চল এবং ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাদা, উটাহ ও অ্যারিজোনার মতো রাজ্যগুলোতেও খরা চলছে।
দাবানলে নাকাল ইউরোপ
ভয়াবহ দাবানলে বিপর্যস্ত ইউরোপের পাঁচটি দেশ। আগুনে পুড়ছে স্পেন, গ্রিস, ফ্রান্স, পর্তুগাল এবং ইতালির বিস্তীর্ণ এলাকা। ইউরো নিউজ বলছে, স্পেনের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে বাতাসের তীব্রতায় দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে আগুন। বনাঞ্চল থেকে আবাসিক এলাকাতেও দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, ৭৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহতম দাবানল মোকাবিলা করছে ফ্রান্স। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ দাবানলে অন্তত একজনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুড়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক সম্পদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওদ অঞ্চলের এই দাবানল ১৯৪৯ সালের পর দেশটির সবচেয়ে ভয়াবহ। প্রধানমন্ত্রী ফ্রঁসোয়া বাইরু একে ‘অভূতপূর্ব মাত্রার বিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেবল ফ্রান্সই নয়, এই গ্রীষ্মে গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন, তুরস্ক, রোমানিয়া ও যুক্তরাজ্যও ভয়াবহ দাবানলের মুখোমুখি হয়েছে। এই দাবানলের প্রভাব তাৎক্ষণিক ধ্বংসযজ্ঞের চেয়েও অনেক বেশি। আগুন ও ধোঁয়া বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং আগুনের স্থান থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মন্তব্য করুন