

ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। তিনি ছিলেন ইতিহাসের সেই কল্যাণরাষ্ট্রের মহান শাসক, যেখানে জনকল্যাণই ছিল রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান লক্ষ্য। যার ভিত্তি ছিল তাকওয়া বা খোদাভীতি আর কর্মপদ্ধতি ছিল শূরা বা পরামর্শভিত্তিক। অর্থাৎ, হজরত ওমর (রা.) ছিলেন সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও হজরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে কল্যাণরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলেও তা সর্বাঙ্গীণ পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছিল ওমর (রা.)-এর মাধ্যমে। তার শাসনামলের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো—
মজলিসে শূরা: হজরত ওমর (রা.)-এর শাসন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মজলিসে শূরা। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে মজলিসে শূরার পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। খেলাফতের কেন্দ্রে এবং প্রাদেশিক সরকার ও প্রশাসনের সব স্তরে প্রয়োজনানুযায়ী শূরাব্যবস্থা চালু ছিল। মজলিসে শূরায় বিজ্ঞ ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হতো। হজরত আলি, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, মুআজ ইবনে জাবাল, উবাই ইবনে কা’ব, জায়েদ ইবনে ছাবেত (রা.)-এর মতো বিশিষ্ট সাহাবিরা ছিলেন ওমর (রা.)-এর শূরার সদস্য। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মজলিসে শূরার সদস্য হলেও সাধারণ জনগণেরও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মতামত দেওয়ার পূর্ণ অধিকার ছিল। তারা সরাসরি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া খলিফাকে তাদের মনের কথা বলতে পারতেন। আর তার জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল মসজিদে নববি।
প্রদেশের সৃষ্টি: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা একটি পরীক্ষিত বিষয়। ওমর (রা.) কর্তৃক সৃষ্ট প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রদেশগুলোর সীমানা নির্ধারণ করেন। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা মতে, ওমর (রা.)-এর খেলাফত মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, জাজিরা, বসরা, কুফা, মিশর ও ফিলিস্তিন—এ আটটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। আর প্রত্যেকটি প্রদেশ গঠিত হয়েছিল কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে। এভাবে তার খেলাফত হয়ে উঠেছিল সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল।
দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ: হজরত ওমর (রা.) প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থেকে কার্যকর পদ্ধতিতে যোগ্যতর লোক নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং পদমর্যাদা ও চাহিদা অনুযায়ী তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতেন। প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ যাতে অবৈধ উপার্জন ও ক্ষমতার অসদ্ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য তাদের কঠোর গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় রাখা হতো। অসততা প্রমাণে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ভূমি রাজস্বই ছিল অর্থ জোগানের মাধ্যম। ভূমির ধরন ও উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে এ রাজস্ব নির্ধারিত হতো। তা ছাড়া ব্যবসায়ের পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক এবং বিজিত অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত অর্থসম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হতো। তার খেলাফত আমলে নাগরিক জীবনের দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি সম্মানিত ও অসহায় নাগরিকদের জন্য বিশেষ ভাতার প্রচলন করেছিলেন।
উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড: ওমর (রা.)-এর সময় ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল। ভূমিব্যবস্থার সংস্করণ, খাল-জলাধার খনন ও সেচব্যবস্থার আধুনিকায়ন, রাস্তা নির্মাণ, গৃহনির্মাণ ও বসতি স্থাপন এবং নতুন নতুন নগর ও শহরের সৃষ্টি ছিল হজরত ওমরের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য দিক। ওমর (রা.) সব ধরনের প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উচ্চবংশীয়, উচ্চশিক্ষিত ও প্রবল ধীশক্তির অধিকারীদের বিচারক পদে নিয়োগ দিতেন। তার আমলে বিচারকদের জন্য উচ্চতর বেতন নির্ধারণ করা হতো। বিচারকার্যে সহায়তার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও প্রবিধি প্রণয়নের লক্ষ্যে কোরআন-হাদিসে বিশেষ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ফতোয়া বিভাগ চালু করা হয়েছিল। ‘আইনের চোখে সবাই সমান’—এ বিধান কথায় নয়, কাজে পরিণত করা হয়েছিল। একবার কোনো এক মামলায় বিবাদী হয়ে কাজি জায়েদ (রা.)-এর আদালতে ওমর (রা.) উপস্থিত হন। তাকে দেখে জায়েদ দাঁড়িয়ে গেলে ওমর (রা.) বলেন, ‘জায়েদ, এটাই তোমার প্রথম অবিচার।’ ওমর (রা.) জায়েদকে আরও বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার সামনে ওমর আর একজন সাধারণ নাগরিক সমান না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি কাজির যোগ্য বিবেচিত হতে পারো না।’ (সূত্র: আব্দুস সাত্তার আশ-শাইখ, খলিফা উমরের রাষ্ট্রনীতি)।
লেখক: ইমাম ও খতিব
মন্তব্য করুন