গত ৫ আগস্ট দেশের ইতিহাস তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে যে নজির নেই—এমন এক বিরল অভ্যুত্থানের সাক্ষী হয় দেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেষ হয় বিগত দেড় দশকের হাসিনা সরকারের স্বৈরশাসন। অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে দেশে সাময়িকভাবে তৈরি হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি, যা কার্যত পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে চলা দুঃশাসনে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সৃষ্টি হয়েছে এক অচলায়তন। এ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তা বাস্তবায়নে প্রাথমিক গুরুদায়িত্ব এখন নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর। স্বভাবতই এ চ্যালেঞ্জ যে পাহাড়সম, বলাই বাহুল্য।
শনিবার কালবেলায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কাল চূড়ান্ত না হলেও সামনে পাহাড়সম কাজ। রাজনীতি-অর্থনীতি-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাজমান অস্থিরতা কাটিয়ে গণমানুষের স্বপ্নপূরণের পথরেখা তৈরি করাই তাদের বড় চ্যালেঞ্জ। তা অর্জনে রাষ্ট্র ও সমাজকে কলুষমুক্ত করতে নিতে হবে নানামুখী পদক্ষেপ। কর্তৃত্ববাদী শাসনে ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্নির্মাণে নিতে হবে সর্বাত্মক সংস্কারের উদ্যোগ। ক্ষমতাচ্যুতদের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থ পাচার ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা তাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুনর্গঠন, বিধ্বস্ত অবকাঠামো সংস্কারসহ ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি গতিশীল করার দায়িত্বও তাদের কাঁধে। রয়েছে দ্রুততম সময়ে দেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরানোর তাগিদ।
আমাদের জন্য গভীর দুর্ভাগ্যের বিষয়, বহিঃশত্রু অর্থাৎ সুদূর পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ, শাসন, দমন, পীড়ন ও নানা বৈষম্যের শিকার হওয়া এবং সেই শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তির জন্য এ জাতি তাদের পরাজিত করল। এর জন্য কত রক্ত, কত ত্যাগ! স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী বছর পেরিয়েও এই জাতিই প্রায় একইভাবে শোষণ ও দমনের পথে হেঁটে চলতে থাকল। তার মানে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যখন যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন, তারাই আশ্রয় নিয়েছেন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির। প্রায় সবাই কমবেশি হয়ে ওঠেন একনায়ক— কী গণতান্ত্রিক বা অগতান্ত্রিক। এই দীর্ঘ পদযাত্রায় তাই আজও গড়ে উঠতে পারেনি জনগণের জন্য একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র। দীর্ঘ এ যাত্রার সর্বশেষ ১৫ বছরে ভেঙেছে অতীতের সব রকমের অনিয়ম, দুর্নীতি ও সরকার কর্তৃক দমন-পীড়নের রেকর্ড—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অর্থাৎ স্বাধীন দেশে আমরাই আমাদের দেশকে শোষণের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছি। কিন্তু সেই অচলয়াতন আর কত! তা তো ভাঙতেই হবে—এই নিয়ম। গত ৫ আগস্ট দেশের আপামর মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ছাত্র-জনতা ধারণ করে তার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে জাতিকে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রের বিরাট সংস্কার।
আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে সবার আগে দরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানো। কেননা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষত পুলিশের অনুপস্থিতিতে দেশব্যাপী ইতোমধ্যে সংঘটিত হচ্ছে নানা অপরাধ। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা হুমকিতে। এ বাহিনীর মতোই প্রশাসনের সর্বস্তরে বৈপ্লবিক সংস্কার জরুরি। রয়েছে অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর বিরাট চ্যালেঞ্জ। সুতরাং সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই সংস্কারের যথাযথ প্রতিফলন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি তাদের বড় দায়িত্ব দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আমরা চাই, সব চ্যালেঞ্জ উতরে নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।