দীর্ঘ ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। আধিপত্যবাদী শাসন অব্যাহত রাখতে এবং সর্বগ্রাসী লুটপাটের ধারা নিশ্চিত করতে বিশ্বের দেশে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসকরা যা করেছেন, শেখ হাসিনাও ঠিক তাই করেছেন। সর্বস্তরে দলীয়করণের মাধ্যমে তিনি নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যমকে ধ্বংস করেছেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে আর দলটি ক্ষমতা থেকে বের হতে চায়নি। একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধীদের ও বিরুদ্ধমত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, আমলা আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে টিকে ছিল দলটি। তারা তাদের শাসনামলের ১৫ বছরে বেশিরভাগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা নিজেরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের যে ক্ষমতার ভিত্তি, তার কোনোটাই টেকসই ছিল না। ফলে সরকারবিরোধী একটা আন্দোলন যখন জোরালো হয়ে ওঠে, সেই আন্দোলন ঘিরে মানুষের ক্ষোভের জন্ম হয়, তখন সেনাবাহিনী, কারফিউ বা পুলিশের পরোয়ানা না করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ গণভবনের উদ্দেশে পথে নেমে এসেছিল। ১৫ বছরের একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, জিনিসপত্রের দাম, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, ব্যাংকিংয়ের অনিয়ম সবকিছু নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটা উপলক্ষ করে পরিবর্তনের আশায় সরকারবিরোধী অবস্থান নেয়।
২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে বাস্তবিক অর্থে আর কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এ সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুটি হয়েছে অনেকটা একতরফা নির্বাচন। ফলে গত ১৫ বছরে মানুষ আসলে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার বা মতামত জানানোর কোনো অধিকার পায়নি।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর সামাজিকমাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিববিরোধী বক্তব্য পোস্ট করার জের ধরে মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ দমনের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে। সরকারবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার জের ধরে মাসের পর মাস কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। সাইবার সিকিউরিটির ভয় দেখানো, মিথ্যা মামলা দেওয়া—মানুষজন একটা ভয়ের মধ্যে ছিল। শেখ হাসিনার সরকার ও পুলিশ বাহিনী মিলে পুরো দেশকে একটা পুলিশি রাষ্ট্রে তৈরি করেছিল। আর এসবের জন্য সবসময়ই সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনী এমনকি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব মামলায় গত ১৬ বছরে জামিন হয়নি, সরকার পরিবর্তনের পর এক রাতের মধ্যে সেসব মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এসব রাজনৈতিক দলের শত শত কর্মী। জামিন দেওয়ার সময় বিচারক মন্তব্য করেছেন, ‘অনেক কথা আছে, যা আমরা বলতে পারি না।’
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নতুন যাত্রার এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের সাহসী ছাত্র ও জনগণের জন্য আমাদের জাতির স্থায়ী পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের যাত্রাটা কঠিন। তাদের আকাঙ্ক্ষা আমাদের পূরণ করতে হবে।’ ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টার এ সাহসী বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো স্থান নেই। এগিয়ে আমাদের যেতেই হবে।