বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী ও খাগড়াছড়িতে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলগুলো ভিন্ন ভিন্ন নদী অববাহিকার অংশ। মৌলভীবাজার মনু নদীর, হবিগঞ্জ খোয়াই নদীর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া তিতাস নদীর এবং কুমিল্লা গোমতী নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। এসব নদী শেষ পর্যন্ত নিম্ন মেঘনা নদীতে মিশে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। তবে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা মুহুরী-কহুয়া নদীর অববাহিকায় অন্তর্গত এবং এ নদী সরাসরি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।
প্রতিটি নদীই একটি নির্দিষ্ট এলাকার বৃষ্টির পানি গ্রহণ করে এবং সেই পানি ভূ-উপরিস্থ প্রবাহ হিসেবে অববাহিকার নদীতে গিয়ে পড়ে। সাধারণত, একটি নদীর অববাহিকা অঞ্চলের বৃষ্টিপাত অন্য নদীকে খুব বেশি প্রভাবিত করে না। তবে বড় বৃষ্টির সময়, বিভিন্ন নদীর প্লাবন এলাকাগুলো একত্রে বড় বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। হাওর এবং অন্যান্য নিম্নাঞ্চলে বড় বন্যার সময় বিভিন্ন অববাহিকার বন্যার পানি একীভূত হয়ে যায়।
উপরোল্লিখিত বেশিরভাগ নদী (মনু, খোয়াই, গোমতী ও মুহুরী) আন্তঃসীমান্ত নদী, যা ভারতের বিভিন্ন পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে উৎপন্ন হয়েছে। এ নদীগুলোর কোনোটিতেই পূর্ণাঙ্গ পানি বণ্টন চুক্তি নেই। ভারত বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা ও পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে একতরফাভাবে এ নদীগুলোর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গোমতী নদীর ওপর অবস্থিত ডুম্বুর বাঁধ হলো এরকম একটি প্রকল্পের উদাহরণ। সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে যে, ভারতের কর্তৃপক্ষ এ বৃহৎ সংরক্ষণ জলাধার থেকে পানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য ডুম্বুর বাঁধের সব স্লুইসগেট খুলে দিয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের কিছু অংশে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ভারত যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ডুম্বুর বাঁধের আয়তন ৫৭ বর্গকিলোমিটারের বেশি এবং এটিতে পানি সংরক্ষণের জন্য ৩০ মিটার উঁচু একটি বাঁধ রয়েছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আগস্ট মাসের ২০ থেকে ২২ তারিখেই মোট ৩২৭ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টি আরও কয়েক দিন ধরে চলতে পারে বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই বৃষ্টিপাতের ফলে বাঁধের পেছনের জলাধারে প্রায় ২০ মিলিয়ন ঘনমিটার বাড়তি পানি জমা হয়ে থাকতে পারে। অল্প সময়ের মধ্যে এ পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়ায় গোমতী নদীর পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, যা গোমতী নদীর অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি করে থাকতে পারে। গোমতী নদী ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন শহর ও জনবসতিগুলোর ভেতর দিয়ে প্রায় ১২০ কিমি অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরের প্রায় ৫ কিমি পূর্বে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যদিও কুমিল্লা শহর বন্যার সম্মুখীন হয়েছে, তবে এটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে একটি নয়। তা ছাড়া, ডুম্বুর বাঁধ থেকে ছাড়া পানির প্রভাব সম্ভবত গোমতী নদী ও ত্রিপুরার নদী উপত্যকায় প্রবাহিত হয়ে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে গেছে। তবে উজানে অবস্থিত প্রতিবেশী হিসেবে, বাঁধ ছেড়ে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করা ভারতের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ভারত দাবি করে যে, তাদের কাছে গোমতী নদীর অমরপুর ও সোনামুড়ায় তিনটি গেজিং স্টেশনে পানির প্রবাহ সম্পর্কিত তথ্য রয়েছে, এ তথ্য সবার সামনে প্রকাশ করা উচিত। শুধু গোমতী নয়, হাওরা, মুহুরী, মনু ও খোয়াই নদীসহ সব আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রবাহের তথ্য সবার জন্য স্বচ্ছ হওয়া উচিত।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হলো ফেনী জেলার পরশুরাম, সোনাগাজী, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা। এসব এলাকাই মুহুরী, ফেনী ও কহুয়া নদীর অববাহিকার অন্তর্গত। এ অঞ্চলগুলো সরাসরি গোমতী নদীর অববাহিকার নয়, যেখানে ডুম্বুর বাঁধ অবস্থিত। ডুম্বুর বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে দেওয়া ফেনী জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে বলে যে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে, তার বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি তেমন নেই। তবে গোমতীর বন্যার পানি অতিপ্লাবনের ফলে মুহুরী অববাহিকায় প্রবেশ করেছিল কি না, সেটি অনুসন্ধান ছাড়া বলা সম্ভব নয়। ডুম্বুর বাঁধ থেকে পানি মুহুরী নদীর অববাহিকা এলাকায় পৌঁছানোর জন্য প্রায় ২০ কিলোমিটার পার্বত্য এলাকা পার করতে হবে, যা ত্রিপুরা রাজ্যের নতুন বাজার এবং জলাইবাড়ির মধ্যে অবস্থিত। ডুম্বুর বাঁধ এবং ফেনীর মধ্যকার সরলরেখার দূরত্ব প্রায় ৬৭ কিলোমিটার। ফেনী ডুম্বুর বাঁধ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। তা ছাড়া গোমতী নদী নতুন বাজার থেকে ত্রিপুরার মেলাঘরের দিকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়।
প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে এবং বিশেষ করে ফেনীতে এত ধ্বংসাত্মক বন্যার কারণ কী? প্রথমত, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, সময় ও মেয়াদ সরাসরি বন্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২২০০ মিমি, যার মধ্যে গড়ে ৬০ শতাংশ (১৩২০ মিমি) বর্ষাকালে ঘটে, অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাসের মধ্যে। ত্রিপুরার দৈনিক দেশকথা সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১ আগস্টে ১৪৫ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়, যা দৈনিক রেকর্ড। শুধু দুই দিনে (২০ ও ২১ আগস্ট) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩২৭ মিমি, যা পুরো বর্ষাকালের বৃষ্টিপাতের ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেও অনুরূপ বৃষ্টিপাতের ধরন দেখা গেছে। বৃষ্টিপাত আরও কয়েক দিন চলবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। এই হারে বৃষ্টিপাত হলে নদীগুলোর বহনক্ষমতা অতিক্রম করে বন্যার কারণ হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছরে বৃষ্টির তীব্রতা ও সময়কাল বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, কৃষি, পাহাড় কাটা, বনভূমি নিধন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ প্রক্রিয়ার ফলে নদীর তলদেশে পলি জমাট হওয়ার কারণে নদীর পানির বহনক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় ভূ-অভ্যন্তরে বৃষ্টির পানির প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যা বন্যার তীব্রতা ও মেয়াদকাল বাড়িয়ে দেয়। লক্ষণীয় যে, বন্যার তীব্রতা শহরাঞ্চলে আরও গুরুতর, যেমন পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও খাগড়াছড়ি। এটি শহরাঞ্চলে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন নেটওয়ার্কের ধ্বংসের কারণে, যেখানে বেশিরভাগ প্রাকৃতিক খাল ও নদী দখলদারদের দ্বারা দখল হয়ে গেছে এবং পানি নিষ্কাশনের নালাগুলো অবৈধভাবে ডাম্পিং দ্বারা আটকে আছে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ফেনী জেলায়ই এক হাজারেরও অধিক নদী-খালের অবৈধ দখলদার রয়েছে। তৃতীয়ত, গত কয়েক দশক সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধির কারণে নিম্নাঞ্চলের নদীগুলোর বন্যার পানি আগের মতো দক্ষতার সঙ্গে নিষ্কাশিত হয় না। মুহুরী নদী ফেনী নদীর মাধ্যমে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। উপকূলের কাছে জোয়ার-ভাটা চক্রের কারণে বন্যার পানি নিষ্কাশন আরও বিলম্বিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।
সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বন্যা সমস্যার সমাধানে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যদিও এগুলোর কোনো সহজ সমাধান নেই। তবে কিছু কার্যকরী উপায় রয়েছে, যা নগর এলাকায় বন্যা ও জলাবদ্ধতা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমাতে সহায়ক হতে পারে। প্রথমত, সব প্রাকৃতিক নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং খনন করে ভূ-উপরিস্থ প্রবাহের বাধাগুলো দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট ভূপৃষ্ঠের জলপ্রবাহ সামলানোর জন্য নিষ্কাশন নেটওয়ার্কের আকার এবং পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। তৃতীয়ত, বৃষ্টির পানি বহনকারী নালা-নর্দমা ও ড্রেনগুলোর কার্যকারিতা এবং বহনক্ষমতা অববাহিকার প্রাকৃতিক ঢাল ও নগরায়ণের মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বৃদ্ধি করতে হবে। চতুর্থত, ভবিষ্যতে সম্ভাব্য বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোর নকশায় অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পঞ্চমত, জাতিসংঘের পানি প্রবাহ আইনের (১৯৯৭) আলোকে সব আন্তঃসীমান্ত নদীর জন্য একটি সমন্বিত পানি এবং পলি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তঃনদীগুলোর অববাহিকার অন্যান্য দেশকেও এ আইন মেনে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে, কারণ এ আইনের মাধ্যমে সব নদী উজান ও ভাটির দেশের ন্যায়সংগত এবং ন্যায্য হিস্যার বিধান রয়েছে। উজান ও ভাটির দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং আন্তরিকতা ছাড়া আন্তঃনদীর অববাহিকার বন্যা সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করা অসম্ভব হবে। ষষ্ঠত, বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রটোকলকে আধুনিকায়ন করতে হবে, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে দ্রুত ও কার্যকরভাবে সতর্কতা সংবাদ জনগণকে জানানো যায়।
লেখক: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, লক হ্যাভেন, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
ইমেইল: [email protected]