সংস্কৃত ভাষার আদি কবি বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গাপূজার কোনো উল্লেখ ছিল না। বাল্মীকি রচিত রামায়ণ যারা পাঠ করেছেন, তারা সবাই এ বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত আছেন। বাঙালি কবি কৃত্তিবাস যখন বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদ করেন, তখন থেকেই দেবী হিসেবে দুর্গার মাহাত্ম্য বাংলাভাষী হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সব সনাতন ধর্মাবলম্বীর কাছে কিন্তু দুর্গাপূজা প্রধান ধর্মীয় উৎসব নয়। মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাভাষী হিন্দুদের মধ্যেই এটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব এবং অত্যন্ত ভাব, ভক্তি ও আনন্দ, উৎফুল্লতায় বাংলাভাষী হিন্দুরা এ পূজাটি উৎসব আকারে উদযাপন করে থাকেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, ৬০০ বছর আগে কৃত্তিবাস ওঝা যখন রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করেন, তখন লোকায়ত গল্পে দুর্গার কাহিনি প্রচলিত ছিল, সেটি রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত করেন কবি কৃত্তিবাস। বাঙালি বাংলা ভাষায় রামায়ণ পেল এবং সেখানে দেখা গেল, দেবী দুর্গার সহায়তায় রামচন্দ্র রাবণকে বধ করতে পারেন, এই যে সত্যের পথ অনুসরণ করে অসত্যকে দূর করা, এ বিষয়টি বাঙালি হিন্দুরা সাদরে গ্রহণ করল। এভাবেই বাঙালি হিন্দু সমাজে কালক্রমে জননী দুর্গা প্রধানতম দেবী হিসেবে আবির্ভূত হলেন। কিন্তু এরপরও প্রধান ধর্মীয় উৎসব হয়ে উঠতে দুর্গাপূজার সময় লেগেছে আরও কয়েকশ বছর। দেবী দুর্গা মানুষের মধ্য থেকে উঠে এসেছেন লোকায়ত গল্পের মাধ্যমে, তাই শারদীয় দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে বড়ই আপন। একটি বিষয় ভেবে বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙালিদের হৃদয় গর্বে ভরে উঠতে পারে, তা হলো—দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল আমাদের এ বাংলাদেশে। কীভাবে সূচিত হলো দুর্গাপূজা পলিমাটি বিধৌত এ বাংলাদেশে, তা আমরা জানতে পারি সাহিত্যিক রাধারমণ রায়ের কাছ থেকে। সাহিত্যিক রাধারমণ রায় লিখেছেন, ‘সেনযুগে দুর্গাপূজা পরিণত হয় রাজরাজড়া আর দস্যু-তস্করের পূজায়। রাজরাজড়ারা এই পূজা করতেন বছরের শ্রেষ্ঠ ঋতু বসন্তকালে। যখন প্রকৃতি ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠত, তখন গরিব প্রজাদের কাছ থেকে খাজনার নামে ছিনিয়ে আনা রক্তরাঙা টাকায় রাজা-জমিদাররা দুর্গাপূজা করতেন জৌলুস-জাহিরের জন্য। সে সময় এই পূজার নাম ছিল বাসন্তী।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, সেনযুগে সূচিত এই বাসন্তীপূজা আকবরের আমলে প্রায় ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন করেন ভাদুরিয়া-রাজশাহীর সামন্তরাজা জগৎনারায়ণ।
আকবরের রাজত্বকালেই ১৫৮০ সাল নাগাদ তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলাদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেন বলে জানা যায়। তাহলে কংসনারায়ণের পূর্বে শারদীয়া দুর্গাপূজার অস্তিত্ব কি ছিল না? রাধারমণ রায়ের মতে, আগে এ দেশে বসন্তকালে হতো দুর্গাপূজা আর শরৎকালে হতো নবপত্রিকা পূজা, যার স্থান আজ গণেশের পাশে। নবপত্রিকাই কালক্রমে চার পুত্র-কন্যাসহ দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিতে রূপান্তরিত। যেহেতু আকবরের রাজত্বকালেই কংসনারায়ণ মূর্তি গড়ে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন, তাই অনুমান করা চলে যে, ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণ যতই জাঁকজমক করে বাসন্তীপূজা করুন না কেন, তার স্থায়িত্ব বেশি দিন ছিল না। বহু অর্থব্যয়ে জগৎনারায়ণের বাসন্তীপূজার দেখাদেখি কংসনারায়ণ আয়োজন করেছিলেন আশ্বিনের শারদীয়া দুর্গাপূজার, যা আজ বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, জগৎনারায়ণ এবং কংসনারায়ণ দুজনই পূর্ববাংলার সামন্তরাজা হওয়া সত্ত্বেও একজনের পূজা-পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে, অন্যজনের পৃষ্ঠপোষিত উৎসব প্রায় বিস্মৃতির অতলে। তবে শারদীয়া দুর্গাপূজার গুরুত্ব বৃদ্ধির পেছনে মোগল আমলে রাজস্ব প্রদানের যে নতুন নিয়ম বলবৎ হয়, তারও খানিকটা ভূমিকা ছিল। নতুন নিয়মে দিল্লিতে মোগল সম্রাটের কাছে প্রাদেশিক শাসনকর্তা, অর্থাৎ নবাবকে ভাদ্র মাসের নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব পাঠানোর নির্দেশ জারি হয়। অর্থাৎ স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের তার আগেই নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা জমা দিতে হতো। এ নির্দিষ্ট খাজনা বাদ দিয়ে রাজস্বের বাকি অংশ ছিল স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের প্রাপ্য। তাই সঞ্চিত রাজস্বের অনুষঙ্গে অর্থনৈতিক দিক থেকে শরতের এ সময়টি ছিল বসন্তের তুলনায় উৎসব উদযাপনের উপযুক্ততর সময়। অতএব হিন্দু রাজা-জমিদারদের একটা বড় অংশ নিজেদের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রতি সমর্থন দেওয়া শুরু করেন। দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল সামন্তরাজাদের বাড়ি থেকে। ক্রমান্বয়ে দুর্গাপূজা সামন্ত প্রভুদের বাড়ি থেকে সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসের রূপ পেল। সম্মিলিত প্রচেষ্টার এ সাংগঠনিক রূপকে আমরা সার্বজনীন পূজা বলে আখ্যায়িত করে থাকি। সম্প্রতি দুর্গাপূজা সার্বজনীন থেকে বিশ্বজনীন রূপ লাভ করেছে। এ বিশ্বজনীনতা এসেছে দুভাবে। একটি হলো বাঙালি হিন্দুদের সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এবং দুর্গাপূজাকে ইউনেসকোর স্বীকৃতি প্রদানের দ্বারা। দুর্গাপূজাকে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইউনেসকো তাদের শিল্প ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কলকাতার দুর্গাপূজা ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেলে তো সারা পৃথিবীর দুর্গাপূজাই বিশ্বজনীন হয়ে পড়ে। মা দুর্গার আরাধনা এবং উৎসবের আনন্দের রং তো সারা বিশ্বে একইরকম। ভাব, ভক্তি, উদযাপনের মধ্যে খুব বেশি কি পার্থক্য আছে? মোটেই নেই। সারা বিশ্বে একই ভাব-ভক্তি, আনন্দ-উল্লাসে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়ে থাকে। দুর্গাপূজার সৌন্দর্য হলো ভাবগম্ভীর পরিবেশে পূজাটির উদযাপন এবং ঢাকঢোল, শঙ্খধ্বনির সাহায্যে সনাতনী সংস্কৃতির প্রবাহমানতা বজায় রাখা।
শুভ শক্তিকে আবাহন এবং অশুভ শক্তিকে অন্তর থেকে দূর করে দেওয়া হলো দুর্গাপূজার মর্ম বাণী। সারা বিশ্বে যখন সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবৈষম্য, শোষণ, অপশাসনের বিস্তৃতি ঘটছে, তখন দুর্গাপূজা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। সব মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখা, সমতার সমাজ গড়ার মধ্যেই দুর্গাপূজা দুর্গোৎসব হয়ে উঠতে পারে। সমাজে যখন সব মানুষ সমানভাবে উৎসব উদযাপনে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়, তখন তা প্রকৃত অর্থে উৎসবে পরিণত হয়। বাংলাদেশে সূচিত দুর্গাপূজার পবিত্রতা রক্ষা করা, পূজা উদযাপনে আরও মানবিক হওয়া সনাতন হিন্দুদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। মা দুর্গার আদর্শ অনুসরণ করে সনাতন ধর্মের অনুসারীরা যদি অন্তরে অবস্থানকারী অসুরকে বিতাড়িত করতে পারে, তাহলে দুর্গাপূজা উদযাপন সার্থক হয়ে উঠবে, দুর্গাপূজা প্রকৃত অর্থে সবার জন্য সার্বজনীন থেকে বিশ্বজনীন উৎসবে রূপান্তরিত হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক