অনেকটা বড় ব্যবধানেই ট্রাম্প কমলাকে হারিয়েছেন আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনে। যেটা হয়তো ট্রাম্পশিবিরের লোকেরাই চিন্তা করেনি। তারা হয়তো ভাবছিল অনেকটা থিন মার্জিনে ট্রাম্প জয়লাভ করবে। ট্রাম্প যখন এ নির্বাচনে লড়ে, তখন তিনি নিউইয়র্ক আদালত কর্তৃক প্রায় ৩৪টি অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। নির্বাচন সামনে না থাকলে হয়তো এতদিনে তাকে জেলেও যেতে হতে পারত। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অসংখ্য আরও অভিযোগ রয়েছে, যেমন আমেরিকার ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গা, নারী কেলেঙ্কারি, জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা, ভুল তথ্য দেওয়া। এর পরও তিনি জনগণের রায়ে আবারও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।
ট্রাম্প যে মন্ত্রটি সবচেয়ে বেশি বোঝাতে পেরেছেন, তা হলো—তিনি ক্ষমতায় এলে অর্থনীতি ভালো হবে। ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট কমে যাবে অথবা বের করে দেওয়া হবে। ফলে তাদের দেশের নাগরিকরা আরও বেশি চাকরি-বাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা পাবে। তার এ মূলমন্ত্রটিই সাধারণ মানুষ লুফে নিয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের লোকজন, যারা কম শিক্ষিত, বয়স্ক, শ্রমিকশ্রেণির লোকজন। অর্থাৎ শহুরে শিক্ষিত, সামাজিকভাবে অনেক সচেতন লোকেরা খুব কমই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে বা দেয়। এটা থেকে বোঝা গেল, দেশের একটা বড় শ্রেণির কাছে তাদের নিজেদের ইস্যুটাই তাদের কাছে মুখ্য। অর্থাৎ চাকরি-বাকরি ও ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা পাওয়া। ফলে তার ইস্যু নিয়ে যে কথা বলছে তাকেই তারা প্রায়োরিটি দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে সেটি মুখ্য বিষয় হয়ে উঠছে না।
আমাদের দেশে গত প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যা, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অবৈধভাবে গুম-হত্যা করা, জেলে ঢোকানো, অর্থ লোপাট, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ এমন কোনো অনৈতিক কাজ নেই, যা তারা করেনি। এত কিছুর পরও তারা উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কিছু সাধারণ ন্যারেটিভ ব্যবহার করে ক্ষমতায় ছিল। মানুষকে তারা এমন হাইপের মধ্যে রেখেছে যে, সমাজের বড় একটা অংশ আওয়ামী লীগের এই প্রোপাগান্ডা বিশ্বাস করত। আমার ধারণা, যদি ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান না হতো; তাহলে হয়তো খুব সহসাই আমরা তাদের এই পতন দেখতে পেতাম না। ছাত্র-জনতা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। ফলে আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে পারছি। প্রশ্ন হলো, আমরা কি এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব?
এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অনেক পন্থা থাকতে পারে। তবে মৌলিকভাবে দুটি জায়গায় আমাদের রাজনৈতিক ঐক্য থাকতে হবে।
১. ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিবাদের চিহ্নিত কোনো গোষ্ঠী, ফ্যাসিবাদকে রিপ্রেজেন্ট করে এমন কোনো সিম্বলকে কোনোভাবেই সফটলি নেওয়া যাবে না। এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যার ফলে ফ্যাসিবাদের প্রতিটি দিক জাতীয় ঘৃণা বা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। উদাহরণ হিসেবে জার্মানির নাৎসি বাহিনী আমাদের সামনে আছে। যদি আমরা অদূর ভবিষ্যতে তাদের সংশোধনের সুযোগ দিই বা কোনোভাবে একসেস দেওয়া হয়, তাহলে তারা সুঁই হয়ে ঢুকবে আবার ফাল হয়ে বের হবে। কারণ আওয়ামী লীগ সহজে মানুষকে বোকা বানাতে পারবে। কয়েকটি ইস্যু সামনে নিয়ে এসে তারা আবার জনতার ম্যান্ডেট বা বাইরের দেশের সহযোগিতায় একই রূপে ফিরে আসবে। আওয়ামী লীগের পরীক্ষা নেওয়ার আর কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় এসে তারা মানুষের বাকস্বাধীনতাসহ যত অপকর্ম করেছে, তার দ্বিগুণ স্পিরিটে একই জাতীয় কাজ তারা গত প্রায় ১৬ বছরে করেছে।
২. আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের (জাতীয়) স্বার্থে এক হতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে একটি নেশন স্টেটের সুযোগ পায়। তাদের একটি টেরিটরি হয়। সেই টেরিটরিতে হয়তো একটি প্রধান গোষ্ঠী থাকে, তবে প্রধান গোষ্ঠীর বাইরেও অনেক ছোট ছোট গোষ্ঠী থাকে যাদের ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতি আলাদা হতে পারে। তবে তারা নেশন স্টেটের ভিত্তিতে একটি জাতি হয়। আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এ জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকারগুলোকে সমুন্নত করা। আবার একইভাবে জাতির অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠীগুলোর দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রকে রক্ষা করা, যখন এই রাষ্ট্র কোনো ধরনের হুমকির মুখে পড়ে। সেটা বাইরের শত্রুর আক্রমণ হোক অথবা হস্তক্ষেপ। এভাবে একটি দেশের জনগণের পরিচয় হয়ে ওঠে ‘আমি বাংলাদেশি’, ‘আমি ইন্ডিয়ান’, ‘আমি পাকিস্তানি’। জাতি রাষ্ট্রে এই অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এবং তার মাধ্যমে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোই হয়ে ওঠে ওই নেশন স্টেটের মূল শক্তি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকেই ‘আমি বাংলাদেশি’ এই স্পিরিটকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব তাদের কাঁধে বর্তায়। এ ক্ষেত্রে বড় দল হিসেবে বিএনপি, জামায়াতেরই দায়িত্ব বেশি জাতীয় ঐক্য তৈরি বা ধরে রাখা। রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গা থেকে তাদের মধ্যে মতৈক্য থাকতে পারে। তারা তাদের নিজ নিজ আদর্শ দিয়ে জনগণকে কনভিন্স করে ক্ষমতায় গিয়ে তাদের মতো করে দেশ পরিচালিত করবে। তবে দেশের প্রশ্নে অর্থাৎ জাতীয় ইস্যুতে তারা এক হবে। অন্যথায় নিজেদের বিভেদ যদি বাংলাদেশি স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে, তাহলে অন্যরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগবে ফ্যাসিবাদীরা, যা আমাদের আবারও দুর্ভাগা জাতি হিসেবে পরিণত করবে।
লেখক: শিক্ষক, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র