মধ্যপ্রাচ্যে যে কারণগুলোর জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না, তার প্রধান একটি হলো ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি। এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে যে ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন, এ সত্যকে আমেরিকা স্বীকার করতে নারাজ। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ সমাধানের উদ্দেশ্যে ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ নামক একটি চুক্তি ঘোষণা করে। আমেরিকার কয়েকজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজস্ব পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেসব পরিকল্পনাতেই ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর প্রথম রজার্স পরিকল্পনা এবং ১৯৭০-এর দ্বিতীয় রজার্স পরিকল্পনা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এর ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু এ চুক্তিপত্রগুলোর কোনোটিতেই সম্পূর্ণভাবে মেনে নেওয়া হয়নি ফিলিস্তিনিদের দাবিদাওয়া।
পরবর্তী সময়ে এসব চুক্তির মাধ্যমে যখন ফিলিস্তিনিদের দাবি দমন করা সম্ভব হয়নি, তখন ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগে, ফিলিস্তিনে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অর্থ ও সীমিত পরিসরে ক্ষমতা চর্চার বিনিময়ে এ নেতারা তেল আবিবের নির্দেশনা মোতাবেক রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনা করতে সম্মত হন। এর ফলে নব্বইয়ের দশকে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির কারণে প্রাথমিকভাবে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কিছু মতভেদ দেখা দিলেও, তাদের স্বাধীনতার দাবি প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তিরা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে অসংখ্য পরিকল্পনার প্রস্তাব করেছে। কিন্তু এ প্রস্তাবগুলোর কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণ বস্তুত এই যে, এ প্রস্তাবগুলোর কোনোটিই নিরপেক্ষ ছিল না। এখানে শুধু ফিলিস্তিনের স্বার্থকেই উপেক্ষা করা হয়নি, একই সঙ্গে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করার সুযোগও করে দেওয়া হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০২০ সালের পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। এ পরিকল্পনার ভিত্তি ছিল মূলত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ২০০৯ সালের ‘অর্থনৈতিক শান্তি’ কর্মসূচি। এটি বাস্তবায়িত হলে তা শুধু ইসরায়েলের জন্যই সুফল বয়ে আনত, ফিলিস্তিনের কোনো উপকার তাতে হতো না। এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, তাদের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার ইতি টানা, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সৈন্যদের অবস্থান চিরস্থায়ী করা এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায় থেকে ইসরায়েলকে মুক্তি দেওয়া। মূলত এটি কার্যকর হলে ফিলিস্তিনিদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যেত। গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ ও গণহত্যা, সমগ্র অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা এবং এসবের পরও ফিলিস্তিনিদের হার না মানার প্রবণতা—এ সত্য প্রমাণ করে দেয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত দুষ্কর। অন্তত যতদিন পর্যন্ত না ফিলিস্তিনিদের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত। পশ্চিমা বিশ্বের থেকে যত শান্তি চুক্তির প্রস্তাবই আসুক না কেন, ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে উপেক্ষা করতে থাকলে, কোনো চুক্তিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
রাজনীতির ক্ষেত্র ছাড়াও যুদ্ধের ময়দানে যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান করতে চাইছে, তাদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য যে, অন্যায় পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থা অনুধাবন করতে গেলে, বিশ্ববাসীর এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, আইনি পদ্ধতি প্রয়োগ করে এ সংঘর্ষ লাঘব করা অসম্ভব। কিন্তু বস্তুত এটা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হবে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং চলমান গণহত্যা বন্ধ করা। এরপর ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর থেকে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর অবৈধ নিয়ন্ত্রণ এবং ফিলিস্তিন অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে তাদের বেআইনি দখল সরিয়ে নিতে হবে। এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যেমন পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন রয়েছে, তেমনি ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়াও রয়েছে। আর এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ্বব্যাপী পর্যাপ্ত সমর্থনও রয়েছে। কিন্তু যেই একটি কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছে না, সেটা হলো ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থন। এ সমর্থনের জোরেই ইসরায়েল বছরের পর বছর কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আসছে।
ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে শক্ত আইনি কাঠামো দাঁড় করানোর উদ্যোগ নতুন নয়। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত আইনি প্রক্রিয়া কার্যকর করা এখন অত্যন্ত প্রয়োজন। গাজা এবং ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্য অঞ্চলে যে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, তার বিচার করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি বিশ্লেষণ উপেক্ষা করতে হবে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে করা মামলার শুনানি হয়। এতে ৫০টিরও অধিকসংখ্যক দেশের প্রতিনিধি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট কেন্দ্র করে নিজেদের নীতিমূলক, রাজনৈতিক এবং আইনি মতামত পেশ করেন। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত আদালতের বিচারপতির সংখ্যা ১৫ জন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা অনুরোধ করেন, তারা যেন ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে ইসরায়েলকে সেনা প্রত্যাহার করতে নির্দেশ না দেন। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা এই মত ব্যক্ত করেন যে, অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং বলপ্রয়োগ করার সম্পূর্ণ অধিকার ফিলিস্তিনিদের রয়েছে।
গত জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক আদালত; এমনকি পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের দখল, ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের বসবাস করতে না দেওয়া, ইসরায়েলি সরকার কর্তৃক প্রাকৃতিক সম্পদ জব্দ করা—এসবই অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আবারও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন। পাশাপাশি আগামী ১২ মাসের মধ্যে ফিলিস্তিনের ভূমির ওপর থেকে তাদের অবৈধ দখল তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়ে রেজল্যুশন পাস করা হয়েছে। এভাবে ইসরায়েলের ওপর একের পর এক চাপ আসছে তাদের যুদ্ধাপরাধ বন্ধের জন্য। গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও কেন এখন ফিলিস্তিন এবং আরব অঞ্চলের অধিবাসীরা ন্যায্য বিচারকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে চাইবে?
মূলত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে যে পথ অবলম্বন করতে হবে, সে পথটা কারোরই অপরিচিত নয়। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বে তার মিত্রশক্তিরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নয়। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা এখনো ইসরায়েলকে অর্থ সরবরাহ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনিদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাদের পরিস্থিতি এমন শোচনীয় হয়ে গেছে, বিচার ছাড়া কোনো সমঝোতায় যাওয়া তাদের পক্ষে এখন অসম্ভব। বিচারের সঙ্গে তারা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা চায়। যতদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল তাদের এ মুক্তির দাবি অগ্রাহ্য করে যাবে, ততদিন পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের চিরস্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হবে না।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক, ‘ফিলিস্তিন ক্রনিকল’-এর সম্পাদক, সেন্টার ফর ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের জ্যেষ্ঠ গবেষক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ