‘বাবুই পাখিরে ডাকি’ বলিছে চড়াই,/ “কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা ’পরে,/ তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।”/ বাবুই হাসিয়া কহে,—“সন্দেহ কি তায়!/ কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।/ পাকা হোক, তবু ভাই পরের ও বাসা,/ নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”
সেই কবে ছেলেবেলায় রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি পড়েছিলাম। উচ্চতর শ্রেণিতে পড়ার সময় কবিতাটি বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় সারমর্ম অথবা ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে আসত। তখন কবিতাটির ভাবার্থ অতটা উপলব্ধিতে আসেনি। স্বাধীনতার মধ্যে যে সুখ নিহিত, তার সঙ্গে অন্য কোনো সুখের তুলনা অবান্তর। এজন্য যুগে যুগে মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়েছে, জীবন দিয়েছে, জীবন নিয়েছে। মানুষ পৃথিবীতে আসে স্বাধীন এক সত্তা হিসেবে। কিন্তু ক্রমেই সে জড়িয়ে পড়ে নানারকম বিধিবিধান ও নিয়মকানুনের শৃঙ্খলে। অবাধ স্বাধীনতা আর থাকে না। একপর্যায়ে সামাজিক রীতিনীতি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে। তারপর রাষ্ট্রীয় আইনের বেড়াজালে সে হয়ে পড়ে আবদ্ধ।
আমার এ নিবন্ধটি যেদিন বেরোবে, তার আগেই শুরু হয়ে যাবে আমাদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। যদিও আমরা ২৬ মার্চকে আমাদের ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ হিসেবে পালন করি, তবে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পেয়েছিলাম ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়েছিল সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হওয়ার যে অপার আনন্দ, তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া অন্যরা বুঝতে পারবেন না। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যারা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে অভ্যুদয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ১৬ ডিসেম্বরের সেই সন্ধ্যার কথা এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। রেডিওতে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে সোল্লাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পৌষের কনকনে শীত উপেক্ষা করে গ্রামের যুবক, কিশোর, বালক-বৃদ্ধ সবাই স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেছিলাম চারদিক। ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে আমাদের সে আনন্দোল্লাসের ধ্বনি পৌঁছে যাচ্ছিল দিকে দিকে। স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দে এক অন্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসিয়েছি বুক। সেই বুকে তখন একটি নতুন দেশ, নতুন আশা, নতুন স্বপ্নেরা বাসা বেঁধে আছে। পরদিন ভোরে যে সূর্যটি পূর্বদিগন্তে উদিত হয়েছিল, মনে হয়েছিল পরাধীনতার অমানিশার অন্ধকার ভেদ করে তা নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য।
কিন্তু স্বাধীনতার সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি বা হতে পারিনি। মুক্ত স্বদেশে ফিরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘তিন বছর আমি তোমাদের কিছু দেবার পারুম না। আরও তিন বছর যদি যুদ্ধ চলত, তোমরা যুদ্ধ করতা না? কষ্ট করতা না?’ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সে কথায় গোটা জাতি সায় দিয়েছিল। তারা কিছুই চায়নি। চায়নি অর্থ-সম্পদ। চেয়েছিল জীবন-ইজ্জত নিয়ে নিরাপদে বাঁচতে। কিন্তু তাদের সে প্রত্যাশা হতাশার ধূলিঝড়ে আচ্ছন্ন হতে বেশি সময় লাগেনি। বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের কথা মেনে নিলেও তার দলের নেতাকর্মীরা তাতে কর্ণপাত করেনি। যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল, সেখানে সৃষ্টি করা হলো বিভক্তি। সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত নীতি অবলম্বন করে জাতিকে বিভক্ত করা হলো। সবচেয়ে হতাশার কথা হলো, একাত্তরে যিনি ছিলেন জাতির ঐক্যের প্রতীক, সেই বঙ্গবন্ধু স্বয়ং সে বিভক্তিকে আশকারা দিয়েছেন। বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্মমভাবে দমনপীড়নের যে পথ তিনি অবলম্বন করেন, তাতে জাতির কাছে তিনি হয়ে পড়েন অপরিচিত এক মুখ। স্বাধীনতা-পূর্ব শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার পরে যেন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
একই সময়ে আরেকটি বিষয় জাতিকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর ‘তিন বছর তোমাদের কিছু দেবার পারুম না’ কথাকে জাতি শিরোধার্য করে নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-পাতিনেতারা দেদার রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নিরন্ন, আশ্রয় ও বস্ত্রহীন মানুষের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে সাহায্য হিসেবে আসে গম, গুঁড়ো দুধ, ঢেউটিন, কাপড়, কম্বল ইত্যাদি। কিন্তু তা দরিদ্র-নিঃস্ব মানুষরা পায় না। চলে যায় রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান-মেম্বার ও আওয়ামী লীগের হোমড়াচোমড়াদের উদরে। শুরু হয় পাকিস্তানি ও অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর-দোকানপাট দখল। শিল্প-কারখানায় আওয়ামী লীগের শ্রমিক নেতারা যথেচ্ছ লুটপাটে লিপ্ত হন। প্রতিবেশী দেশে অবাধে পাচার হতে থাকে দেশের সম্পদ। চারদিকে এহেন লুটপাট দেখে এবং তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকারপ্রধান শেখ মুজিব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পাইছি চোরের খনি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে নয় কোটি কম্বল আইল, কিন্তু আমি পাইলাম না। চাটার দলের চাটারা আমার কম্বলটাও বেইচ্চা খাইছে।’ আরও বললেন, ‘পাকিস্তানিরা আমাদের সব সম্পদ নিয়া গেছে, রাইখা গেছে কতগুলি চোর। এই চোরগুলারে নিয়া গেলে বাঁচতাম।’ শেখ মুজিবের এ আক্ষেপ ছিল সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের একজন অসহায় সরকারপ্রধানের ক্ষোভ ও হতাশার বহিঃপ্রকাশ। তার সে ক্ষোভ ছিল নিজ দলের দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, পাচারকারী-চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণ বা দমনে অক্ষমতাপ্রসূত।
মূলত আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়িত হতে পারেনি, ক্ষমতাসীনদের সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতার কারণে। পাশাপাশি দেশপ্রেমহীন একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ-লুটেরা খাবলে খেয়েছে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে। যার ফল ১৯৭১-এ স্বাধীনতার যে সুখ আমরা কল্পনা করেছিলাম, তা দুরারোগ্য অসুখে রূপ নিতে সময় লাগেনি। সুচিকিৎসা না হওয়ায় তা আর নিরাময় হয়নি। বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। মূলবোধ, দেশপ্রেম আজ পুস্তকের বাণীতে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে এর সন্ধান পাওয়া সাগর সেচে মুক্তো তুলে আনার সমতুল্য। স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছর পর আজ পেছন ফিরে তাকালে শুধু একটি এলোমেলো পথচলার পদরেখার চিহ্নই দৃশ্যমান হয়।
একাত্তরে যখন কতিপয় রাজাকার-আলবদর ছাড়া গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন সবার মনে ছিল একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আশা। কিন্তু জাতির সে প্রত্যাশা সর্বাংশে পূরণ হয়নি। নানাভাবে তা বিপর্যস্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে অগণতান্ত্রিক শাসন চেপে থেকেছে জাতির ওপর বছরের পর বছর। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগই আবির্ভূত হয়েছিল চরম ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে। ২০০৯ থেকে চলতি বছর ৪ আগস্ট পর্যন্ত টানা পৌনে ষোলো বছর এই দলটি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল বাংলাদেশের মানুষের বুকের ওপর; যে বুকে বাসা বেঁধেছিল শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়নহীন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আশা। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, জুলুম-নির্যাতনের বিভীষিকাময় দিন পার করে, হাজারো বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শাসনের নিগড় থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মুক্তির আনন্দের আতিশয্যে কেউ কেউ এটাকে আখ্যায়িত করতে শুরু করেন ‘নতুন স্বাধীনতা’ হিসেবে। সে সময় আমি একটি জাতীয় দৈনিকে নিবন্ধ লিখেছিলাম, ‘স্বাধীনতা বারবার আসে না’ শিরোনামে। (প্রকাশ: ১৪ আগস্ট, ২০২৪)। আমি বলতে চেয়েছি, ৫ আগস্ট আমরা একটি ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি, তবে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। সুতরাং ৫ আগস্টকে আমরা ‘ফ্যাসিবাদের পতন’ অথবা ‘গণতন্ত্রের মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করতে পারি।
এটা ঠিক, চলতি বছর ৫ আগস্ট একটি অবিস্মরণীয় দিন হিসেবেই ইতিহাসে স্থান পাবে। কেননা, এ দিনে জনরোষের জোয়ারে ভেসে গিয়েছে ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রাসাদ। পনেরো বছর গোটা জাতিকে পদতলে পিষ্ট করে স্বৈররাজত্ব কায়েমকারীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর সে স্বৈরশাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে অবারিত হয়েছে গণতন্ত্রের দুয়ার, জাতি ফিরে পেয়েছে কথা বলার অধিকার। এ অর্জনও এক ধরনের স্বাধীনতা। কিন্তু চার মাসের মাথায় এসে সে স্বাধীনতার অপব্যবহারের বিষয়টি প্রকটভাবেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কর্নার থেকে জাতিকে অস্থিতিশীল করে তোলার একটি হীনপ্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। নানান রকম দাবিদাওয়া নিয়ে যেভাবে রাজপথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা হচ্ছে, তা শুভলক্ষণ নয়। অন্যদিকে সরকারকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে। সম্ভবত পূর্বতন সরকারের মতো নির্যাতনের অভিযোগের ভয়ে। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের এসব দাবিদাওয়া আগে কোথায় ছিল? পতিত সরকারটির আমলে যখন টুঁ-শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন তো এরা ভালো মানুষের মতো চুপ করে ছিল। এখন ‘স্বাধীনতা’ পেয়ে জোয়ারের খলসে-পুঁটির মতো খলবল করতে শুরু করেছে। সচেতন ব্যক্তিরা অবশ্য এসব দাবিদাওয়া-বিক্ষোভের পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত ও বিপর্যস্ত করে দেশে একটি ভিন্নতর পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। তারা মনে করেন, গোড়াতেই সে ষড়যন্ত্রের শিকড় উপড়ে ফেলতে সব দ্বিধা কাটিয়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের কঠোর হওয়া উচিত। কারণ, স্বাধীনতার অপব্যবহার করে কোনো গোষ্ঠীকে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র সফল করতে দেওয়া যাবে না।
বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকে অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের মাতৃহীন দুই ছেলেমেয়ে একদিন পিতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা স্বাধীনতা কাকে বলে?’ নূর উত্তর দিলেন, ‘স্বাধীনতা হলো নিজেদের ইচ্ছেমতো চলা।’ শিশুরা বলল, ‘তাহলে কাল থেকে আমরা স্কুলে যাব না।’ নূর সায় দিলেন। কয়েক দিন পর দেখা গেল সকালবেলায় শিশু দুটো স্কুল ড্রেস পরছে। পিতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমারা না স্বাধীন, স্কুলে যাচ্ছে কেন?’ শিশুদের উত্তর, ‘স্বাধীনতা ভালো লাগে না বাবা।’
আসলে সবকিছুরই সীমা আছে। স্বাধীনতারও তেমনি। স্বাধীনতা মানেই যা খুশি করার লাইসেন্স নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা তা ভুলে যাই। আর সেখানেই যত বিপত্তি।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক